কোভিড-১৯ মহামারির ফলে সৃষ্ট সংকট এবং এর জন্যে দায়ী ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকরা ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। সবাই খেয়াল রাখছেন, যাতে শারীরিক সংস্পর্শের পরিমাণ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা যায়।
করোনা মহামারীর ফলে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারও অনেক বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পেমেন্ট গ্রহণের পদ্ধতি এবং গ্রাহকরা যে পদ্ধতিতে পেমেন্ট করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে সেসবও বদলে গেছে।
ডেটাবেজ প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা’র মতে, ২০২১ সালে ডিজিটাল পেমেন্ট ক্ষেত্রে মোট লেনদেনের পরিমাণ ৫৯,২০,৪৬০ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছাতে পারে। আর এই ক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১২.০% এ গিয়ে দাঁড়াবে বলেও আশা করা হচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এক্ষেত্রে মোট লেনদেনের পরিমাণ ৯৩,১৬,৯১৭ মিলিয়ন ইউরোতে গিয়ে পৌঁছাবে। ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ডিজিটাল বাণিজ্য বা ই-কমার্সের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি লেনদেন হবে। চলতি বছরের মধ্যে শুধুমাত্র ই-কমার্সের মাধ্যমেই সম্ভাব্য লেনদেনের পরিমাণ ৩৭,১৫,৭৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছাতে পারে।
এবার ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যে বিষয়গুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে, সেগুলি এক নজরে দেখে নেয়া যাক।
১. ডেটার সাহায্যে নির্মিত পেমেন্ট ভ্যালু চেইন-
উন্মুক্ত ব্যাংকিং এবং অন্যান্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেন করলে তাতে যেই ডেটা পাওয়া যায়, তার মূল্য অনেক বেশি। এই ডেটার সাহায্যে প্রচুর পরিমাণে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। যেমন, এসব ডেটার সাহায্যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং ভোক্তাদের জন্যে কার্যকর আর্থিক পরিকল্পনা করা কিংবা সহজেই জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব।
পেমেন্টের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান এই ডেটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। ডেটা অ্যানালিটিক্স টুলস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Ai) -এর মতো প্রযুক্তি পেমেন্টের জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পেমেন্ট শিল্পের ভ্যালু চেইনে ডেটার সাহায্যেই পরিবর্তন আসবে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি সময়ের সাথে সাথে পেমেন্ট ডেটা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের গুরুত্ব দেখতে পাবে। এবং যদি এই প্রযুক্তির ফলে পণ্য ও সার্ভিসের জন্যে ভোক্তাদের আরো কম অর্থ খরচ করতে হয়, তাহলে তারাও আরো বেশি পরিমাণে ডেটা শেয়ার করতে সম্মত হবে। ডেটার সহজলভ্যতা এবং কার্যকারিতার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখতে ডেটার সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সঙ্গতি আনতে পারাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কে ডেটা নিয়ন্ত্রণ করবে বা কীভাবে বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হবে, তা নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য বিভিন্ন মানদণ্ডে সুরক্ষা এবং অবাধ বাণিজ্যকে আরো ভালোভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।
২. অবাধ পেমেন্ট-
আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যে ই-কমার্স ও খুচরা ব্যবসার ক্ষেত্রে গ্রাহকের সামনে থাকা বাধা-বিপত্তিগুলি কমানো জরুরি।
অবাধ পেমেন্ট পদ্ধতিতে ডেটা ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ডিভাইস এবং অ্যাপ্লিকেশন গ্রাহকদের জন্যে ক্রয় এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্যে বিক্রয় সহজ করে তুলবে। এতে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবে, গ্রাহকের অভিজ্ঞতাও উন্নত হবে এবং প্রতিষ্ঠানের আয়ও বাড়বে।
৩. নগদ লেনদেন ছাড়াই অর্থনীতি-
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকের মতে, আমরা কখনোই সম্পূর্ণ নগদ লেনদেন ছাড়া অর্থনীতি তৈরি করতে পারবো না। তবে চলমান করোনা মহামারী আমাদের পণ্য কেনার জন্যে পেমেন্টের অভ্যাসে প্রভাব ফেলেছে। মহামারীর কারণে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটা এবং কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্টর হার বেড়েছে।
কোভিড-১৯ এর আগে থেকেই অবশ্য নগদ লেনদেনের পরিমাণ কমে এসেছিল। তবে সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা কমে আসার পরও এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। গ্রাহকরা ভবিষ্যতেও চেষ্টা করবেন, যাতে শারীরিক যোগাযোগ এবং নগদ লেনদেন এড়িয়ে পেমেন্ট করা যায়।
৪. ব্যাংক অ্যাকাউন্টের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি-
ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার মাধ্যমে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাথে গ্রাহকের নতুন ধরনের সম্পর্ক তৈরি হবে। এবং এতে করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রয়ে পেমেন্ট পদ্ধতিও উন্নত হবে। গুগলের মতো টেক জায়ান্টরাও এখন গ্রাহকদের ব্যাংকিং এর মতো সেবা দেয়া শুরু করছে। ফলে ভবিষ্যতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও প্রোডাক্ট বা পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
পেমেন্ট পদ্ধতি সহজ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকদের আরও সুবিধা প্রদান করাটাই ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্ট এবং সঞ্চয় করার মূল উদ্দেশ্য। পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলিও বর্তমানে তাদের পদ্ধতি আরো পার্সোনালাইজ করছে। একই সাথে পণ্যের পরিসর বৃদ্ধি করে গ্রাহকদেরকেও আরো সুবিধাজনক অভিজ্ঞতা দিচ্ছে।
৫. কন্টাক্টলেস পেমেন্ট-
ভবিষ্যতে দ্রুত, নিরাপদ এবং সুরক্ষিত পেমেন্ট পদ্ধতিগুলি প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশেষ করে কন্টাক্টলেস লেনদেন বেড়ে যাওয়ায় আরও বেশি মানুষ তাদের স্মার্টফোন থেকে পেমেন্ট করবে।
মহামারী চলাকালীন সময়ে সামাজিক দূরত্বের কারণে কন্টাক্টলেস পেমেন্টের হার বেড়েছে। আবার ভোক্তাদের আচরণ পরিবর্তিত হতে থাকায় অনেকে নতুন করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে পেমেন্টের স্বাচ্ছন্দ্য বুঝতে পারছে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কমতে পারে এবং সাথে সাথে ডিজিটাল ওয়ালেটের ব্যবহার বাড়তে থাকবে।
সফটওয়্যার ভিত্তিক POS (পয়েন্ট অফ সেল) প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ার সাথে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের গ্রাহকদের কাছে নতুন এই পেমেন্ট পদ্ধতি সরবরাহ করছে।
৬. বায়োম্যাট্রিক্স-
মোবাইল প্রযুক্তি আজ আমাদের জীবনকে আরো সহজ করে তুলেছে। আমরা আমাদের ডিভাইসগুলি আনলক করতে কিংবা পণ্য আর সার্ভিসের বিনিময়ে পেমেন্টের জন্যে অর্থ প্রদান করতে আমাদের আঙুলের ছাপ বা মুখের ছবি ব্যবহার করতে পারছি।
ফেসিয়াল অ্যানালিটিক্স এবং বায়োমেট্রিক ডেটা এখন আরো প্রচলিত হয়ে উঠছে। এই প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করার মতো পরবর্তী পদক্ষেপ হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যার মাধ্যমে অনলাইনে বা স্টোরে আপনার মুখের ছবির মাধ্যমে পেমেন্ট সহজ করে তুলবে।
৭. সংযুক্ত বাণিজ্য-
সংযুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতারা তাদের আগে কিনে নেওয়া কোনো আইটেম বা পণ্য পুনরায় রিফিল বা প্রতিস্থাপনের সময় হলে গ্রাহকদের জানাতে পারবে।
সংযুক্ত বাণিজ্য বা কানেক্টেড কমার্স নানাভাবেই ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের সাহায্য করতে পারে। তবে এর মূল গ্রোথ ক্যাটেগরিগুলি হলো ওয়্যাররেবল টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, হোম অটোমেশন, অটোমোটিভ এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স।
৮. রিয়েল-টাইম পেমেন্ট মূলধারা হয়ে উঠছে-
বর্তমানে রিয়েল-টাইম পেমেন্টকে ঘিরে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন হচ্ছে। আগামি এক দশকের মধ্যেই বিশ্ববাজারে রিয়েল-টাইম পেমেন্টই হবে আদর্শ পেমেন্ট সিস্টেম। দেশের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সেটেলমেন্ট সিস্টেমের মধ্যে পার্থক্য কমে আসবে। এবং ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিকভাবে তহবিল সরবরাহ করার মতো নানা সুবিধা লাভ করবে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপদ পেমেন্ট সম্ভব হবে। এবং এর ফলে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ক্ষুদ্র পেমেন্টের পরিমাণও ব্যাপক ভাবে বাড়বে।