অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত হচ্ছে আর্থিক ব্যবস্থা বা ফাইনানশিয়াল সার্ভিসে সবার সমান অংশ নেয়ার সুযোগ থাকা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একজন ব্যক্তি তার আয় বৃদ্ধি করতে পারে এবং সম্পদ গড়ে তুলতে পারে। ফলে সর্বোপরি তার উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্ত দেখা যায়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ব্যাংকিং খাতে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় কম।
অতীতে বিশেষজ্ঞরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, ‘ফিনটেক’ বা ফিনান্সিয়াল টেকনোলজির মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীরা আরও বেশি অংশ নিবে এবং এই খাতে নারী-পুরুষের যে ব্যবধান রয়েছে, সেটা কমে যাবে।
কিন্তু ফিনটেক কি আসলেই অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পেরেছে? এর উত্তর বের করার জন্যে ২৮টি দেশের ২৭,০০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকে নিয়ে বিশ্বব্যাংক একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা ফিনটেক সার্ভিস ও এর বিভিন্ন প্রোডাক্ট নিয়ে তাদের অভিমত দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকিং সিস্টেমে ব্যবহৃত ফিনটেক সার্ভিস এবং নতুন ফিনটেক স্টার্টআপ, উভয় ক্ষেত্রেই যারা লেনদেন করেন, তাদের অভিমত নেয়া হয়েছে। এছাড়াও গবেষণা প্রতিবেদনে বয়স, জেন্ডার এবং ব্যক্তিগত অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে নেয়া তথ্য সাজানো হয়েছে।
অর্থনীতিতে নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্য-
গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা গেছে যে, ফিনটেক এখনো পর্যন্ত নারীদের উপর আশানুরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। জরিপে অংশ নেয়া ২৯% পুরুষ যেখানে ফিনটেক ব্যবহার করে, নারীদের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ২১%।
অর্থাৎ, শতকরা হারে ৮% বৈষম্য এখানে রয়েই গেছে, যাকে ‘পারসেন্টেজ গ্যাপ’ বা ‘‘পারসেন্টেজ পয়েন্ট” বলা হয়ে থাকে। প্রায় সব দেশেই এই গ্যাপ রয়েছে। বয়স, আয়, শিক্ষা, বৈবাহিক অবস্থা, পেশা কিংবা আর্থিক সাক্ষরতার মতো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের হিসাব অনুসারে এই গ্যাপের পেছনের কারণ হিসেবে কেবল ৩০% এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অর্থাৎ একই দেশের একই অঞ্চলের এবং একই আয়ের সমবয়সী দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে ফিনটেক ব্যবহারে ৫ পারসেন্টেজ পয়েন্ট গ্যাপ রয়ে গেছে। প্রচলিত ব্যাংকিং সিস্টেমে কি এই জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গবৈষম্য দেখা যায়?
গবেষণায় উঠে এসেছে, বিশ্বে ৭২% পুরুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। অন্যদিকে নারীর ক্ষেত্রে তা মাত্র ৬৫%। এখানে ৭% জেন্ডার গ্যাপ দেখা যাচ্ছে, যা অন্তত ফিনটেক খাতে বিদ্যমান জেন্ডার গ্যাপের চাইতে কম। Average Adoption Rate বিবেচনা করলে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে তা ৬৯% হলেও ফিনটেকের ক্ষেত্রে ২৫%। তার মানে এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য আরও স্পষ্ট। তাই গবেষণার সকল রিপোর্ট বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে, ফিনটেকের প্রচলন বাড়ার ফলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়নি।
এই পার্থক্য থেকে আমরা কী বুঝি?
কারা ফিনটেক প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়ছে, তার ওপর কি মানুষের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয়?
গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৯% মানুষ জানিয়েছেন যে, তারা নতুন ফিনান্সিয়াল প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছেন। তবে সেগুলি তাদের পরিচিত ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকেই। অন্যদিকে নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্ট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এর হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৫%-এ।
তবে দুই ক্ষেত্রেই পুরুষেরা নারীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। জেন্ডার গ্যাপের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, নতুন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সেটা ৯ পারসেন্টেজ পয়েন্ট আর পুরনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৮ পারসেন্টেজ পয়েন্ট। অর্থাৎ, পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে কে সার্ভিস প্রদান করছে সেটা খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। অর্থাৎ ফিনটেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেন্ডার গ্যাপ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নতুন নাকি পুরনো প্রতিষ্ঠান সার্ভিস দিচ্ছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হচ্ছে, তারা কী প্রোডাক্ট নিয়ে সার্ভিস দিতে চাচ্ছে, সেটা।
কাজের পরিধির বিচারে এই ফিনটেক প্রোডাক্টগুলি বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন কিছু প্রোডাক্ট এমন হতে পারে, যেগুলি এখনকার ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের পরিপূরক। যেমন অনলাইন বাজেট টুলস, ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং টুল বা এগ্রেগেটর। আবার এমন প্রোডাক্টও হতে পারে যেগুলি একদম নতুন, যেগুলি প্রচলিত প্রোডাক্টের জায়গা দখল করে নেবে। যেমন, পিয়ার টু পিয়ার পেমেন্ট বা ডিজিটাল ব্যাংকিং।
অংশগ্রহণকারীদের এমন ১৯ ধরনের প্রোডাক্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়। সেখানে দেখা যায়, নারীরা নতুন ফিনটেক প্রোডাক্টের চেয়ে পুরনো ফিনটেক প্রোডাক্ট ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। নতুন এবং পুরনো দুই ধরনের প্রোডাক্ট গ্রহণে জেন্ডার গ্যাপ থাকলেও পুরনো ফিনটেক প্রোডাক্ট ব্যবহারে জেন্ডার গ্যাপ নতুন প্রোডাক্ট ব্যবহারের তুলনায় ৫০% কম।বিষয়টির আরও গভীরে যাওয়ার জন্যে গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন, এখানে সামাজিক কাঠামোর কোনো ভূমিকা আছে কি না। যেসব পরিবারে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত পুরুষেরা নেয় সেখানে বেশি ফিনটেক ব্যবহার হয়, নাকি যেসব পরিবারে নারীরা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে বেশি ফিনটেক ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই পরিবারের ওপরও জরিপ করা হয়। এখানেও দেখা যায়, নারী প্রধান পরিবারে ফিনটেক ব্যবহৃত হয় কম।
গবেষকরা আরো দেখার চেষ্টা করেছেন, ফিনটেক ব্যবহারে নারীদের কম আগ্রহের কারণ সামগ্রিকভাবে টেকনোলজি এবং প্রাইভেসি নিয়ে নারীদের মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত কিনা। জরিপে দেখা গেছে, নারীরা নতুন টেকনোলজি গ্রহণে পুরুষদের মতো আগ্রহী না। যেমন, ডিজিটাল ব্যাংকের কথা বলা যেতে পারে। নারীরা ভালো অফার বা কম রেটে প্রোডাক্ট পাওয়ার জন্যে ব্যাংকের সঙ্গে তাদের ডেটা শেয়ার করতে কম ইচ্ছুক। একই ভাবে অনলাইন সিকিউরিটি নিয়েও নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি চিন্তিত থাকে।
নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা-
এই জেন্ডার গ্যাপের পেছনে ঠিক কোন কারণ রয়েছে, তার সঠিক উত্তর এখনও আমরা জানি না। অনেক কিছুর ওপরেই নির্ভর করতে পারে। হয়তো নারী এবং পুরুষের মধ্যে পছন্দের তফাৎ থাকতে পারে। যেমন, এদের মধ্যে কারা বেশি ঝুঁকি নিতে চায় বা লাভ-ক্ষতির হিসাব কে কীভাবে করে। এগুলির উত্তর আবার পূর্বের ঘটনা দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। যেমন, পূর্বে যদি কোনো নারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস নিতে গিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন, তবে পুনরায় এই সার্ভিস গ্রহণে তিনি আগ্রহী নাও হতে পারেন। সেটা ফিনটেক সার্ভিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
শেষে বলা যায়, আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নারী-পুরুষের যে দুই রকম মন-মানসিকতা রয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি বা অলিখিত আইন। এগুলি বিবেচনা করে নারীরা কস্ট বেনফিট অ্যানালিসিসে ফিনান্সিয়াল সার্ভিস থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাছাড়া, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নারীদের মনোভাব থেকে জেন্ডার গ্যাপের একাংশের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে জেন্ডার গ্যাপ নিয়ে গবেষণা করার সময় এই বিষয়গুলির ওপর বেশি জোর দেয়া যেতে পারে।
নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পাবলিক পলিসি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে শুধুমাত্র ফিনটেক দিয়ে অর্থনীতিতে জেন্ডার গ্যাপ কমানো সম্ভব হবে না। বরং ফিনটেক জনপ্রিয় করার জন্যে সরকারী নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। এই নীতি প্রণয়ন এমনভাবে হতে হবে, যাতে লিঙ্গবৈষম্য কমানো যায় ও সবার কাজে লাগে, এমন উদ্ভাবনী সার্ভিসে গুরুত্ব দেয়া হয়।