বিটকয়েন সারাবিশ্বে একটি কৌতুহল উদ্দীপক মুদ্রা ব্যবস্থা। এই বিটকয়েনের সাথে কোনো রিজার্ভ ব্যাংকের সংযোগ না থাকায় এখানকার লেনদেন এবং মূল্য নির্ধারণ ট্রেডিশনাল নিয়মে করা সম্ভব হয় না। তাই অনেক দেশে এই বিটকয়েন মুদ্রা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় না। বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত দক্ষতা কম হওয়ার কারণে বিট কয়েনের মতো এত জনপ্রিয় ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের সহকারী পরিচালক শফিউল আজম জানান, বিটকয়েন সংরক্ষন আদতে অপরাধ বলার সুযোগ নেই। যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সি মালিকানা, সংরক্ষন আমাদের দেশে এখনও স্বীকৃত না।
শুরুতে বিভিন্ন দেশ এই ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রহনে অস্বীকৃতি জানালেও, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মান, ও ভারতের মতো দেশগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সি গ্রহন করছে। সম্প্রতি টেসলার সিইও ইলন মাস্ক ঘোষনা দিয়েছেন ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ‘টেসলা কার’ গুলো ক্রয় করা যাবে। এরপর থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি গুলোর চাহিদা এবং দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে।
অনেকে ধারণা করছেন, এই ব্লকচেইন টেকনোলজির মাধ্যমে পরিচালিত বিটকয়েনগুলো হতে চলেছে আগামীদিনের মুদ্রা ব্যবস্থা। কারণ এই মুদ্রাব্যবস্থায় কোন দেশের সরকার ব্যবস্থার হাত নেই। ফলে যে কেউ চাইলে মুদ্রার মান কমিয়ে বাড়িয়ে ফেলতে পারেন না। এই মুদ্রা ব্যবস্থায় নিরাপত্তাও অনেক ভালো।
আজকে আমরা জানবো- বিটকয়েন কি, বিটকয়েনের মত আর কি কি ক্রিপ্টোকারেন্সি বের হয়েছে, বাংলাদেশে বিটকয়েনের বৈধতা এবং বিটকয়েনের সুবিধা অসুবিধা এই সকল বিষয় নিয়ে।
বিটকয়েন কি?
বিটকয়েন এক ধরণের মুদ্রা ব্যবস্থা, যেখানে অন্যন্য মুদ্রার মত লেনদেন করা যায়। তবে পার্থক্য হচ্ছে, অন্যন্য মুদ্রার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রন থাকে, যা বিটকয়েনে থাকেনা। এটি একটি ব্লকচেইন ভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ব্যবস্থা।
বিটকয়েন সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় ২০০৯ সালে। বিটকয়েনের আবিষ্কর্তার নাম নিলে বলতে হয় সাতোশি নাকামোতো এর কথা। যদিও তিনি একাই কি এই বিটকয়েন সৃষ্টি করেছেন, নাকি তাঁর পুরো টিম এই বিটকয়েন সৃষ্টি করেছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে এখনও।
বিটকয়েন মুদ্রা ব্যবস্থা জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো এখানে পরিচয় গোপন করে লেনদেন করা যায়। বিটকয়েনের একটা লিমিটেশন আছে। মোট ২ কোটি ১০ লাখ বিটকয়েন এর মাধ্যমে লেনদেন করা সম্ভব হবে। এর বেশি বিটকয়েন তৈরি করা যাবে না।
অল্প সংখ্যক বিটকয়েন দেখে অনেকে ধারণা করতে পারেন এটি তো খুব শিগ্রই ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। বিটকয়েন কিন্তু ভগ্নাংশেও কেনা যায়। এক সাতোশি সমান এক বিটকয়েনের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ। সাতোশি মূলত বিটকয়েন এর প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুযায়ী নামকরণ করা হয়েছে।
বিটকয়েনের মত আর কি মুদ্রা ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে?
প্রচলিত বাজারে বিটকয়েন অনেক সাড়া ফেলার কারণে বর্তমানে অনেক রকম নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি বের হয়েছে। এখনও অবধি ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৪ হাজারের মত ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। তবে সবগুলো যদিও যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং এই বাজার ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ধারণা করা যায়, নিকট ভবিষ্যতে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো হতে পারে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা।
মাইনিং কি?
বিটকয়েন মাইনিং হচ্ছে, কম্পিউটারের মাধ্যমে লেনদেনের বিষয়টি বৈধতা নিশ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া। যখন নতুন কোন ট্রানজেকশন হয়, তখন ঐ ট্রানজেকশনটি সঠিক কিনা তা নির্ধারণ করতে মাইনিং করতে হয়। যেহেতু বিটকয়েন মুদ্রাব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর হস্তক্ষেপ থাকেনা, তাই এখানকার লেনদেন গুলো ভেরিফাই করতে হয় মাইনিং এর মাধ্যমে।
বিটকয়েন ব্যবহারের সুবিধা-
বিটকয়েন ব্যবহার করা প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার তুলনায় সহজ। কম্পিউটার আর ইন্টারনেট সম্পর্কিত সাধারণ জ্ঞান থাকলে বিটকয়েন এর জন্য অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এই বিটকয়েনের ব্যবহারের অন্যতম আকর্ষনীয় কারণ হচ্ছে লেনদের গোপনীয়তা। এই মুদ্রাব্যবস্থায় নাম, ঠিকানা সবকিছু গোপন করা যায়।
এই মুদ্রাব্যস্থায় রয়েছে যথেষ্ট স্বচ্ছতা। প্রতিটি লেনদেনের বিপরীতে রয়েছে ব্লকচেইন ভিত্তিক হিস্ট্রি। অর্থাৎ আপনি কোথা থেকে সর্বপ্রথম লেনদেন শুরু করেছেন, তা থেকে আজ অবধি সবকিছুর ডাটা রয়েছে।
যেমন আপনার হাতে ১০০ টাকার নোটটি প্রথম কার কাছ থেকে লেনদেন করা শুরু হয়েছিলো, কোথায় কোথায় কার কার কাছে গিয়েছে তা আপনি জানতে পারেন না। হয়তো সর্বোচ্চ তিনজন বা চারজন এগের লেনদেনকারীর সম্পর্কে জানতে পারেন। কিন্তু বিটকয়েন মুদ্রা ব্যবস্থায় প্রতিটি লেনদেনের হিসেব থাকে। তবে তা অবুশ্যই আপনার নাম পরিচয় গোপন রেখে।
বিটকয়েন ব্যবহারের অসুবিধা-
বিটকয়েনের ওয়ালেট হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। লেনদেন যদি অসম্পূর্ণ হয়, তা ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। সেই সাথে ক্রেডিট ব্যবস্থাও নেই। আমাদের মাঝে অনেকের কাছে ক্রেডিট ব্যবস্থাটি অনেক জনপ্রিয়। তাই ক্রেডিট ব্যবস্থা না থাকা অনেকের জন্য অসুবিধা বটে।
বিটকয়েনের কারণে কারো বৈধ বা অবৈধ লেনদেন-এর হিসেব রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু প্রচলিত সাধারণ মুদ্রা ব্যবস্থায়, অনৈতিক যেকোন ধরণের লেনদের জন্য রেস্ট্রিকশন করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন কেউ যদি কোন অবৈধ পন্য ক্রয় করে, তার ব্যাংকিং লেনদেন জব্দ করে তাকে সতর্ক করার উপায় থাকে।
কিন্তু বিটকয়েনের মাধ্যমে তা করার উপায় থাকেনা। বরং বিটকয়েন দিয়ে অনেক রকম অবৈধ লেনদেন করা হয় যা অন্য মাধ্যমে করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও বিভিন্ন ধরণের ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম ওয়েবসাইটের বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সবাই বিটকয়েন পছন্দ করে থাকে।
ফলে সরকারি ভাবে কোন ধরণের কার্যক্রম পর্যবেক্ষনে রাখা সম্ভব হয় না। যা দেশের সিকিউরিটির জন্য একপ্রকার বাধা স্বরূপ। এই কারণে অনেক দেশ বিটকয়েনের লেনদেনকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না।
বিটকয়েনের দাম কখন বাড়ে?
বিটকয়েনের দাম গনমাধ্যমের প্রচারণার উপর নির্ভর করে। গনমাধ্যমে ভালো কিছু শেয়ার হলে, বিটকয়েনের দাম বেড়ে যায়। আবার নেটিবাচক কিছু ছড়িয়ে পড়লে বিটকয়েনের দাম কমে যায়। তখন অনেকে বিটকয়েন অনেকে বিক্রি করে দেয়। যেমন টেসলার প্রধান ইলন মাস্ক যখন ঘোষণা দিলেন, তাদের কার গুলো বিটকয়েনের মাধ্যমে ক্রয় করা যাবে, তখন হুট করেই বিটকয়েনের দাম আকাশ্চুম্বি হয়ে যায়।
বিটকয়েনের মূল্য কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
বিটকয়েনের চাহিদা ও জোগান, মাইনিং এর খরচ, ব্লকচেইনে যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক, বিটকয়েনের পরিমাণ, লেনদেনের মাধ্যম, দেশ ভিত্তিক বিধিনিষেধ, এবং অভ্যন্তরিন পরিচালনব্যবস্থার উপর বিটকয়েনের মুল্য উঠানামা করে।
বিটকয়েন মুদ্রাব্যবস্থায় কোন প্রকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রনব্যবস্থা না থাকায়, সফটওয়ার ডেভেলপার এবং মাইনারদের উপর নির্ভর করতে হয়।
বাংলাদেশে বিটকয়েন-
বাংলাদেশে বিটকয়েন মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক। এই মুদ্রাব্যবস্থা “১৯৪৭; সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর দ্বারা সমর্থিত হয় না” বিধায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধরণের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর সিকিউরিটি ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন রকমের কথা আমরা প্রায় শুনে থাকি। তাই, নতুন কোন রকম পদক্ষেপ নিতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক এর অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। বিটকয়েনের মত বিভিন্ন ধরণের জটিল ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন ট্র্যাক করা বাংলাদেশ ব্যাংক এর জন্য আপাতত চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কারনে ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই।
বিশ্বের অনেক দেশ শুরুতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে ‘না’ বললেও পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ বেশ কিছু বড় অর্থনীতির দেশ এই মুদ্রা ব্যবস্থাকে ‘হ্যাঁ’ বলেছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধ। এছাড়া টেসলার মত জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে তাদের পন্য ক্রয় করা যাবে। তাই আমরাও আশা করতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশেও ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হবে।