গ্রাহক-কেন্দ্রিক পণ্যের নকশা বা হিউম্যান-সেন্ট্রিক ডিজাইনকে অনেকসময় ‘অংশগ্রহণমূলক ডিজাইন’ও বলা হয়। কারণ এতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রাহকের সুবিধাও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
পণ্য পরিকল্পনার এই পদ্ধতিতে প্রাধান্য দেয়া হয় মানুষের দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা, আবেগ ও আচরণকে। সৃজনশীল এই পদ্ধতিতে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই পণ্যটি চূড়ান্তভাবে যিনি ব্যবহার করবেন মাথায় রাখা হয় সেই গ্রাহকের কথা। মোটকথা, ব্যবহারকারীর সমস্যা সমাধানই এই নকশা পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।
গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশার ব্যাপারটি সেই সমস্ত ডিজাইনারদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, যারা গ্রাহকের চাহিদা সবার প্রথমে রাখেন এবং ব্যবহারকারীর চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার ব্যাপারেই মনোযোগ দেন।
প্রোডাক্ট ডিজাইনের আগে তারা গ্রাহকদের আসল প্রয়োজন, সমস্যা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন এবং লক্ষ্য বোঝার জন্যে সময় নেন।এভাবে চিন্তাভাবনা করার ফলে গ্রাহকদের সাথে তাদের একধরনের মানসিক সংযোগ তৈরি হয়। ফলে এ ধরনের ডিজাইনাররা প্রতিনিয়তই এমন সব পণ্য তৈরির চেষ্টা করেন, যা মানুষের প্রকৃত সব সমস্যা সমাধানে কার্যকরী। আর এসব প্রোডাক্ট ব্যবহার করে গ্রাহকদের জীবনেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
প্রথম এবং দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের কারণে পণ্য প্রক্রিয়াজাত করার পদ্ধতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফলে মানুষের ব্যবহারের জন্যে বিশেষভাবে উৎপাদন করা পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। জীবাশ্ম জ্বালানী, বাষ্পশক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় এসকল শক্তিচালিত বিভিন্ন যন্ত্র দ্রুতগতিতে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা করে। এবং সেই পরিবর্তনের পথ ধরে আজও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিবর্তন আসছে।
আধুনিক শিল্পভিত্তিক নকশা বা ডিজাইন পদ্ধতির শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। এ সময়ে মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি করে পণ্য এবং সেবা গ্রহণ শুরু করে। ফলে দৈনন্দিন পণ্যের ক্ষেত্রে যেসব পণ্য একই সাথে ব্যবহারকারীর প্রয়োজন মেটায় এবং সুবিধাজনক, সেসব পণ্যের নকশা উন্নত করাটা জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপরও ভোগ্যপণের পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন এবং উৎপাদনে চূড়ান্তভাবে পণ্যটি যারা ব্যবহার করবেন, তাদের প্রয়োজন বিবেচনায় রাখার ব্যাপারটি উপেক্ষিতই রয়ে যায়। পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে থেকে যায় মূলত তারকা ডিজাইনার, প্রকৌশলী এবং “স্কুলস অব থট” নামে পরিচিত ভাবনার কিছু ধরন। ১৯ শতকের শেষ থেকে প্রায় ২০০০ সাল পর্যন্ত পণ্য নকশার এই চিরাচরিত পদ্ধতি স্থায়ী হয়েছিল।
তবে সময়ের সাথে সাথে পণ্য উৎপাদনে গ্রাহকের বাস্তব প্রয়োজন আমলে না নিয়ে শিল্পযুগের প্রথাগত সেই পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। পণ্যের চূড়ান্ত ব্যবহারকারী ও গ্রাহকের কথা মাথায় রেখে গ্রাহক-কেন্দ্রিক পণ্যের নকশা পদ্ধতিই এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
গ্রাহকের যুগ-
গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতিতে একদম শুরু থেকেই পণ্য বা সার্ভিসের নকশা প্রণয়নে গ্রাহকদের কথা ভাবা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মানুষের সমস্যা, লক্ষ্য এবং প্রয়োজন মেটাতে চূড়ান্ত পণ্যটি “হিউম্যান-সেন্ট্রিক ডিজাইন” পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়।
কেবলমাত্র পণ্য উৎপাদনে অংশগ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই নয়, বরং এসব বিষয় ছাড়াও গ্রাহকদের পণ্য ব্যবহারে যথাযথ গবেষণার ভিত্তিতেই গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতি গড়ে ওঠে। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত পণ্যটির ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করার মাধ্যমে পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন পরিকল্পনাতে জোর দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াতে “ইউজার-এক্সপেরিয়েন্স” নিয়ে যেসব ডিজাইনার কাজ করেন, তারা পণ্য উৎপাদনে নানান সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি গ্রাহকদের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ পান।
পরবর্তী ধাপগুলিতে ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা সমাধান, পণ্যটির কাঙ্ক্ষিত ভোক্তা শ্রেণী বা গ্রাহকদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং চাহিদা যাচাইয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়। এভাবে সমস্ত দিক বিবেচনা মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের ব্যাপারটা গুছিয়ে আনা হয়।
গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক আয়ে প্রভাব রাখার পাশাপাশি এটি উন্নততর পণ্য উৎপাদনের রাস্তা তৈরি করে, যেগুলি বাস্তব দুনিয়ার সমস্যা সমাধানে মানুষের জন্য অধিক কার্যকরী।
একটি পণ্য আসলে কারা ব্যবহার করবেন, সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না রেখে যারা পণ্য উৎপাদন করতে চান, তারা দ্রুতই ব্যর্থতার মুখ দেখেন। পণ্যের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট সঠিক প্রশ্নগুলির উত্তর যাচাই করতে না পারা এবং শুরু থেকেই পণ্যের চূড়ান্ত গ্রাহকের কথা মাথায় না রাখা হলে পণ্যটি বাজারে অচল হয়ে পড়বে।
ব্যবহারকারীদের নিয়ে গবেষণার জন্যে পরিচালিত “ইনভেস্টিগেটিভ ফেইজ” গ্রাহক-কেন্দ্রিক পণ্য নকশা পদ্ধতির একটি অতি জরুরি ধাপ। এই ধাপেই সুচিন্তিত প্রশ্নের মাধ্যমে ভোক্তাদের চাহিদা যাচাই করা হয়। আর এই অনুসারেই পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন বিষয় নির্ধারণ করা হয়। এবং গ্রাহকদের মানসিকতা বিবেচনা করেই ডিজাইনাররা পণ্যের নকশা করা শুরু করেন।
ডিজাইনাররা পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন সুযোগ শনাক্ত করে গ্রাহকদের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গটি বোঝার জন্যই মূলত “ইনভেস্টিগেটিভ ফেইজ” এর প্রশ্নগুলি ব্যবহার করেন। আর এর মধ্য দিয়েই তারা আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আমরা কীভাবে বিশ্বকে দেখি, তা আমাদের মানসিকতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতির সঙ্গে একজন শিক্ষানবিসের মানসিকতার অনেক মিল রয়েছে। একজন শিক্ষানবিশ যেকোনো বিষয়েই আশাবাদী থাকেন এবং নিজের বুদ্ধিমত্তা অনুসারে কাজ করার চেষ্টা করেন।
সফলভাবে সম্পন্ন হলে গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতিতে এমন সব পণ্য উদ্ভাবন করা সম্ভব, যেগুলি ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয়তার সাথে অধিকতর সংশ্লিষ্ট।এসব পণ্যই মূলত ভোক্তার অংশগ্রহণ এবং অগ্রগতিকে নিশ্চিত করবে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা গুগল, ইবে, এবং লিংকডইন-এর মতো বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও আরো বেশি করে গ্রাহক-উপযোগী, সুচিন্তিত, গোছালো এবং উন্নত সার্ভিসের নকশা প্রণয়নে বিনিয়োগ করতে দেখছি।
সর্বোপরি, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র বাস্তবায়ন করলেই হবে না, বরং গ্রাহক-কেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতিতে এসব সমস্যার সমাধান নির্ধারণে মনোযোগী হতে হবে।