NFT- কি?
NFT এর পূর্ণ রূপ Non-Fungible Token। টোকেন শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। রেস্টুরেন্ট এ খেতে গেলে অর্ডার দেয়ার পর আমাদের হাতে একটা টোকেন দেয়া হয়, যেন ওয়েটার বুঝতে পারে কোন টেবিল এ কোন খাবার দিতে হবে। ঢাকার বাণিজ্য মেলাতে ঘুরতে গেলে আমরা পার্শ্ববর্তী এলাকাতে গাড়ি বা বাইক পার্ক করার সুবিধা দেখি। গাড়ি সেখানে রাখার পর আমাদের হাতে একটা টোকেন দেয়া হয়। মেলায় ঘুরে ফিরে আমরা আবার সেই টোকেন জমা দিয়ে গাড়ি নিতে পারি। টোকেন ছাড়া গাড়ির মালিক যে আপনি, সেটা প্রমাণ করা যায় না। প্রযুক্তির দুনিয়াতেও টোকেনকে ঠিক একইভাবে ব্যবহার করা হয়। মালিকানা আর লেনদেন এগুলো প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে একটি টোকেনরুপী রশিদ এর। কিন্তু Non-Fungible দিয়ে আসলে কি বোঝান হয়?! ইংরেজি ভাষায় Fungible শব্দের অর্থ- একটি বস্তু বা ধারণা যাকে তার সমকক্ষ এক বা একাধিক বস্তু/ধারণা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করা যায়। আরেকটু সহজ করে বলি। আমরা অনেক সময় দোকানে গিয়ে ৫০০ টাকার নোটের ভাংতি চাই। তখন দোকানের লোক আমাদের পাঁচটা ১০০ টাকার নোট দেয়। সুতরাং একটি ৫০০ টাকার নোট কে অন্য একাধিক নোট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। অনেক সময় আমরা ভাতের বদলে রুটি খেয়েও থাকতে পারি। সুতরাং এগুলো Fungible বস্তু বা ধারণা। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় – হুমায়ুন আহমেদ এর “মিসির-আলী’ বা “হিমু’ চরিত্র অন্য কোন চরিত্র দিয়ে শতভাগ মিল রেখে লিখতে, সেটা আসলে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেই চলে আসে Non-Fungible
ধারণা। Non-Fungible Token বা NFT প্রযুক্তি বিশ্বে কোন মৌলিক প্রোডাক্ট এর মালিক কে এবং সেটির মালিকানার মুল্য বর্তমানে কত সেই বিষয় নিয়ে কাজ করে। এবং এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কোন ধরনের জালিয়াতি সম্ভব নয়, কারন এতে ব্যবহৃত হয়- ব্লকচেইন টেকনোলজি।
NFT- র ইতিহাস-
২০১৭ সালে সর্বপ্রথম দুইজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার তাদের তৈরি একটি ডাটাবেজ প্রোগ্রাম ব্লকচেইন এর মাধ্যমে নিলামে তোলেন এবং বিস্ময়করভাবে সেটি অনেক দামে বিক্রি হয়। এর পেছনে কারণ হিসেবে ধরা হয়, তাদের তৈরি সেই প্রোগ্রামটি দুনিয়ার আর কারও কাছে ছিলনা এবং ব্লকচেইন এর মাধ্যমে বিক্রি করার কারণে এর মালিকানা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব। কেউ এই প্রোগ্রামের কপি করলে, ব্লকচেইন এর কারণে কখনো এর মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এই ধারণা থেকেই, Non-Fungible প্রোডাক্ট বেচাকেনার ক্ষেত্রে চালু হয় NFT । তবে এই প্রযুক্তি বিশ্বব্যপী জনপ্রিয়তা লাভ করে এই বছর- অর্থাৎ ২০২১ সালে।
টুইটার এর সিইও জ্যাক ডরসি তার প্রথম টুইট এর একটি ক্লিপ NFT- র মাধ্যমে নিলামে তোলেন। ধারণা করতে পারেন সেটি কত দামে বিক্রি হয়? ২.৫ মিলিয়ন ডলার। হ্যা আপনি ঠিকই পড়েছেন। জ্যাক ডরসির প্রথম টুইট ইন্টারনেটে একটিই আছে এবং একারণে এর এত দাম। বিপল নামে একজন ডিজিটাল আর্টিস্ট এর পাঁচ হাজার ছবির একটি পোর্টফলিও বিক্রি হয়েছিল ৬৯ মিলিয়ন ডলারে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন একটি অনন্য জিনিস এর মুল্য এবং মালিকানা কত বড় ব্যাপার হতে পারে।
কিভাবে কাজ করে NFT–
NFT কিভাবে কাজ করে তা জানতে হলে আমাদের প্রথমে দুটি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে এখানে যে প্রোডাক্ট বেচাকেনা করা হয় সেটি সম্পূর্ণ মৌলিক হতে হয় । কোন প্রোডাক্ট একই সাথে সলিড অথবা ডিজিটাল হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের কোন তাঁতি যদি হাতে সেলাই করা একটি নকশি কাথা বানান যেটি পৃথিবীর আর কারও পক্ষে বানানো সম্ভব না হয়; তাহলে সেটিকে একটি NFT সলিড প্রোডাক্ট বলা যায়। আবার কোন শিল্পী যদি তার কণ্ঠে গাওয়া একটি গানের অডিও রেকর্ড করেন, তাহলে সেই রেকর্ড করা ফাইলটি একটি ডিজিটাল প্রোডাক্ট। এখন আসি দ্বিতীয় বিশয়টি নিয়ে। NFT প্রযুক্তি এথেরিয়াম ব্লকচেইন দ্বারা সুরক্ষিত । এর মাধ্যমে করা বেচাকেনার ফলে নতুন মালিকানার রেকর্ড পরিবর্তন করতে বা কোনও নতুন এনএফটি অনুলিপি করতে পারবেন না। ফলে শুধুমাত্র একটি টোকেন এর মাধ্যমে একজন ক্রেতা তার প্রোডাক্ট এর মালিকানা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছে এবং যেহেতু NFT প্রোডাক্ট কিছুটা মুল্যবান হয় তাই এর নিরাপত্তা ও সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে। সহজ ভাষায় বললে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে এমন একটি দলিল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যেটু সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কি কি কেনা-বেচা করা যাবে?
যেকোন মৌলিক বস্তু/বিষয় NFT মার্কেটে বেচাকেনা করা সম্ভব। আপনার জমি, গাড়ি ও বিক্রি করতে পারবেন এর মাধ্যমে যদি সেটির আর কোন নকল বা কপি না থাকে। আসুন জেনে নিই আর কি কি ক্রয়- বিক্রয় করা সম্ভব এর মাধ্যমে-
ডিজিটাল আর্ট-
আপনি আঁকতে ভালোবাসেন। গাইতে পারেন অসম্ভব সুন্দর গান। তাহলে আপনার তৈরি করা আর্ট আপনি চাইলে বিক্রি করতে পারবেন NFT প্লাটফর্মে। এরকম আরও উদাহরণ- গানের সুর, কবিতা আবৃত্তি, আর্কিটেকচার ডিজাইন এবং আরও অনেক।
কালেক্টিবলস-
আমরা অনেকে প্রাচীন পয়সা সংগ্রহ করি। কারও সংগ্রহে থাকে বিভিন্ন দেশের ষ্ট্যাম্প । কারও বা শখ বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সব খেলোয়াড়ের পরিহিত জার্সি. এরকম সংগ্রাহকদের আগ্রহ থাকা বস্তু NFT এর মাধ্যমে লেনদেন করা হয়।
অনলাইন গেম ম্যাটেরিয়াল-
এমন অনলাইন গেম আছে যেখানে আপনি আপনার নিজের মত করে গেম এর ম্যাপ সাজিয়ে নিতে পারেন। ভাল পারফর্ম করে পেতে পারেন কোন বিশেষ অস্ত্র বা ক্ষমতা। এসব ভারচুয়াল অ্যাসেট বা সম্পদ ও আপনি চাইলে NFT তে রাখতে পারেন বিক্রির উদ্দেশ্যে।
বই-প্রবন্ধ-রিসার্চ-
আপনার লেখা গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ ও সম্পূর্ণ মৌলিক । আবার কোন রিসার্চ পেপার ও সম্পূর্ণ আপনার দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ । এগুলো ও এখন NFT প্লাটফর্মে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে।
NFT- ভবিষ্যৎ-
বিশ্বের অনেক দেশেই এখনও NFT মার্কেট আইনগত জটিলতার সম্মুখীন । অনেক প্রাচীন মুল্যবান বস্তু NFT এর মাধ্যমে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে পারে, এই শঙ্কার কারণে অনেক দেশ এখনো সম্পূর্ণ অনুমতি দেয়নি এটাকে। তবে প্রযুক্তির দুনিয়ার অনেক মহারথী এই সেক্টরে বিনিয়োগ করেছেন। এবং ধারণা করা হচ্ছে, ব্লকচেইন যখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে, তখন NFT আরও ভাল বাজার পাবে। ই কমার্স ইন্ডাস্ট্রি তে এখনও মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি অনেক দুর্বল। আবার একই সাথে চুরি করা/ কপি করা প্রোডাক্ট ও বিক্রি চোখে পড়ে কালোবাজারিদের মধ্যে। NFT প্রযুক্তি সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে। অনলাইন মার্কেটপ্লেসগুলোতে আসবে স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা। আর সবথেকে বড় যে কাজটি করতে পারবে NFT, সেটা হল এটি কারও নিজস্ব স্বকীয় প্রতিভাকে সম্পূর্ণ তার মালিকানা দান করবে। কপিরাইট এর যুগ শেষ হয়ে যাবে; এই অকাট্য দলিল ব্যবস্থায়।