ইলন মাস্ক প্রযুক্তি বিশ্বে বর্তমানে অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি, বিলিয়নার উদ্যোক্তা। ইলনকে আমরা সবাই চিনি বিশেষ করে ইলেকট্রিক কার এবং স্পেস এক্সের কারণে। বার বার প্রজেক্ট ব্যর্থ হওয়ার পরও হাল না ছাড়া এই ব্যক্তির এক টুইটে এখন প্রায় ৪ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগ্যান করা সম্ভব হয়।
ইলেক্ট্রিক কার এবং স্পেস এক্সের বাইরেও ইলন মাস্ক আরো বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করে থাকেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো স্টারলিংক। এই স্টারলিংকের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বজুড়ে স্যাটেলাইটের সাহায্যে ইন্টারনেট বলয় সৃষ্টি করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর ধারণা নিয়ে আসেন ২০১৪ সালের দিকে।
এর মাধ্যমে বর্তমানের ব্রডব্যান্ডের তুলণায় আরও দ্রুত গতিতে ডাটা স্ট্রান্সফার করা সম্ভব হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও অলরেডি স্টারলিংক-এর সাবস্ক্রিপশন বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছে। যেহেতু আগামীতে প্রযুক্তি বিশ্বে এই ইন্টারনেট সেবায় স্টারলিংক দারুন এক বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে হাজির হয়েছে। আমরা আজকের আলোচনার বিষয় ঠিক করেছি, এই স্টারলিংক নিয়ে।
আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো, স্টারলিংক কি, কিভাবে কাজ করবে, বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি থেকে বাড়তি কি সুবিধা এই স্টারলিংক আমাদের প্রদান করবে, এই সম্পর্কে।
এতি যেহেতু বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বের ব্রডব্রান্ড এর বিকল্প হিসেবে তৈরি হচ্ছে, তাই বিষয়টা বুঝতে হলে শুরুতে আমাদের বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে তা সম্পর্কে ধারণা নেয়া প্রয়োজন।
বর্তমান ইন্টারনেট প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?
সারা বিশ্বে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট প্রযুক্তি চালু হয়েছিলো ২৯ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে ‘ARPANET’ এর মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের কল্যানে ARPA এই যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বর্তমানে আমরা যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি তা মূলত সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে এক দেশ অন্য দেশের সাথে সংযুক্ত। মূলত স্ট্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে রিয়েলটাইম ডাটা ট্রান্সমিশন কস্ট কমানোর জন্য ক্যাবলের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট সংযুক্ত রয়েছে।
যেমন বাংলাদেশের রয়েছে “SEA-ME-WE 4”, “ SEA-ME-WE 5” ইত্যাদি সাবমেরিন ক্যাবল। এই ক্যাবল গুলোর মাধ্যমে আমাদের দেশের সমস্ত ইন্টার্নেট প্রযুক্তি নির্বিগ্নে পরিচালিত হচ্ছে। সাবমেরিন ক্যাবল গুলোর অনেক রকম সুবিধে থাকলেও, এর অসুবিধেও নেহাত কম নয়।
মেনটেইনেন্স কস্ট থেকে শুরু করে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ নির্মান সবসময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় সাগরের তলদেশে বিভিন্ন উপায়ে সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সংযোগ খুঁজে বের করে সমস্যা সমাধান করা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্ট সাধ্য ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়।
এতদিন এই সমুদ্র তলদেশের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ-এর বিকল্প না থাকার কারণে এই প্রযুক্তিতে ভরসা করতে হচ্ছে। কিন্তু ইলন মাস্ক ভালো একটি আইডিয়া বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। তার প্রস্তাবনা এই যে- সারা বিশ্বে ইন্টারনেট সেবা দেয়া হবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ১ লক্ষেরও বেশি স্যাটেলাইট নির্মান করে লো-অরবিটে পাঠিয়ে তাৎক্ষনিক ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা যাবে এমন ধারনা নিয়েই মূলত স্টারলিংক এর জন্ম।
স্টারলিংক কি?
স্টারলিংক হচ্ছে এক প্রকার স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যা স্পেস এক্স কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। স্টারলিংক এর মাধ্যমে স্যাটেলাইট কে ব্যবহার করে সর্বত্র ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া সম্ভব হবে। যা আমাদের বর্তমান ইন্টারনেট সংযোগের ট্রান্সমিশন এর মত দ্রুতগতি সম্পন্ন হবে। যার লেটেন্সি হবে সর্বনিম্ন 20ms। বিশেষ করে যেসকল অঞ্চলে এখনও ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়নি, সেই সকল অঞ্চলে স্যটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া হবে এই স্টারলিংক এর মাধ্যমে।
কোন কোন ফিচারগুলো আমাদেরকে স্টারলিংক এর প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম?
স্টারলিংক-এর মাধ্যমে আনলিমিটেড ডাটা ট্রান্সমিশন সম্ভব হবে। যার সম্ভাব্য স্পিড হবে ১৫০-৩০০ ১৫০-৩০০ মেগাবাইট/সেকেন্ড। স্টারলিংক-এর সবচেয়ে ভালো ফিচার হচ্ছে এটি লো লেটেন্সি প্রদান করতে সক্ষম। আমরা যখন ডাটা ট্রানমিট করি, তখন ডাটা অপরপ্রান্তে পৌঁছাতে বেশ কিছু সময় নেয়। বেশি কতটুকু সময় নিয়ে থাকে, তা পরিমাপ করার উপায় হচ্ছে লেটেন্সি রেইট। এই লেটেন্সি রেইট যত কম হবে, তত কম সময়ে ডাটা ট্রান্সমিট করা সম্ভব হবে।
স্টারলিংক আরও একটি কারনে জনপ্রিয় হতে পারে, তা হলো একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে সক্ষম। বর্তমানে মোবাইল নেটওয়ার্ক-এর জন্য টাওয়ার সংযোগ প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করা কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু স্টারলিংক এর নেটওয়ার্ক কমিউনিকেশন হবে সরাসরি স্ট্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যা সমতল ভূমি হোক অথবা অসমতল ভূমি হোক কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না।
ভারতে স্টারলিংক-
এই বছর নভেম্বরে টেসলার স্টারলিংক ইন্ডিয়াতে তাদের কম্পানি রেজিস্টার করেছে। তাদের মূল উদ্দ্যেশ টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিস প্রদান করা। যেমন ব্রডব্রান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস, কন্টেন্ট স্টোরেজ, স্ট্রিমিং, মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশন এর মত সার্ভিসগুলো। এছাড়াও এটি স্যাটেলাইট ফোন, নেটওয়ার্ক ইকুপমেন্ট, ডাটা ট্রান্সমিশনে কাজ করবে।
কোন ১৯ টি দেশে স্টারলিংক বর্তমানে পরিক্ষামূলক চালু করা হয়েছে?
টেসলা শুরুতে যেভাবে বলেছিলো, তাতে মনে হয়েছিল সারা বিশ্বে একযোগে কভারেজ চালু করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবে তা করে ওঠা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত পর্যাপ্ত পরিমানে স্যাটেলাইট কন্সটেলেশনে যা পাঠানোর কারনে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ছে। তবে সব যায়গা কভারেজ না করা গেলেও, বেশ কিছু অঞ্চলে তারা এই স্টারলিংক সেবা চালু করতে পেরেছে।
বর্তমানে স্টারলিংক এর সেবা আপনি নিতে পারবেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। এছাড়াও প্রি-অর্ডার চলু রয়েছে ইতালি, পোল্যান্ড, স্পেইন, এবং চিলিতে।
স্টারলিংক স্যাটেলাইট এর কারণে কি ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে?
স্টারলিংক এর কার্যক্রম যেহেতু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এবং প্রচুর পরিমানে স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রয়োজন হতে পারে মহাকাশে, তাই অনেক বিজ্ঞানীর সঙ্কা মহাকাশের আসল সৌন্দুর্য হারিয়ে যাবে। প্রচুর পরিমানে স্যাটেলাইট মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশে বিভিন্ন বস্তু দেখতে সমস্যা হবে। কারণ তখন টেলিস্কোপে শুধুমাত্র এই স্যাটেলাইট গুলো দেখা যাবে।
যেহেতু স্যাটেলাইট গুলো লো-অরবিটে অবস্থান করবে, সেহেতু এই স্যাটেলাইটগুলো রাতের আকাশে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে। তারার বদলে আমরা ইলন মাস্কের এই স্যাটেলাইট গুলো দেখতে পাবো। যদিও ইলন মাস্ক রাতের আকাশকে পরিষ্কার রাখতে বেশ কিছু স্যাটেলাইট ভার্সন পরিক্ষা করছে। সেগুলো হলো- ডার্কস্যাট, ভাইসর স্যাট ইত্যাদি।
যদি আবহাওয়ার পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে কি হবে স্টারলিংক এর সাথে?
পৃথিবীর এক অংশের আবহাওয়া এক রকম। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার আকষ্মিক পরিবর্তন সবাইকে চমকে দিতে পারে। এই পরিস্থিতে স্টারলিংক কি নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে?
স্টারলিংক এর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটের এফএকিউ সেকশনে তারা পরামর্শ দিয়েছে, যেখানে প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত হয়, সেখানে কিছুটা স্লোতে ডাটা ট্রন্সমিশন হবে। এছাড়াও প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং ঝড়ো হাওয়ার কারণে ইন্টারনেট সেবা কিছুটা ধীরগতি সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্টারলিংক প্রযুক্তি ব্যবহারে খরচ কেমন?
স্টারলিংক এর সাবক্রিপশন ফি মান্থলি ৯৯ ডলার এবং প্রাথমিক অবস্থায় পাহাড়ি বা দূর্গম এলাকায় ইনস্টলেশনের জন্য প্রথমে খরচ পড়বে ৪৯৯ ডলার। এই ধরণের প্রাইস অনেকটা আগ্রাসী হলেও ইলন মাস্কের দাবি, যারা একেবারে ইন্টারনেট সেবার বাইরে, এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, তাদের জন্য লাভজনক হবে।
এছাড়াও স্পেসএক্সের প্রেসিডেন্টের দাবি, আগামী বছর থেকে তারা ইনস্টলেশন কস্ট আরও কিছু কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।