গত কয়েক দশকে অন্য যেকোনো শিল্পের চেয়ে রোবোটিক্স প্রযুক্তি শিল্পে অনেক নতুনত্ব এসেছে। এতে ব্যবহারিক দিক দিয়ে মূল্যহীন অনেক রোবটও তৈরি হয়েছে। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি অরিগামি-ফোল্ডিং রোবট এবং ডিজনির তৈরি স্যান্ড-আর্ট রোবট আমাদের বাস্তব জীবনে তেমন কোনো কাজে আসবে না।
তবে সময়ের সাথে সাথে এই শিল্পটি বিকশিত হয়ে উঠেছে এবং ধীরে ধীরে জটিল বিভিন্ন কাজের জন্য রোবট ব্যবহারের নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রোবট অনেক সময় জীবন রক্ষাকারীও হতে পারে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তিতে রোবোটিক্স অনেকটাই এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ চিকিৎসাসেবায় ব্যবহারের জন্যে রোবটের সীমাহীন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আগামিতে চিকিৎসা সেবায় রোবোটিক্স প্রযুক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে, এমন ৫টি রোবোটিক্স প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. ব্লাড ন্যানোবটস-
মানুষের রক্তে ভাবে ন্যানোবট ব্যবহারের জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই প্রযুক্তির সম্ভাবনার কথা চিন্তা করলে অবাক হয়ে যেতে হয়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা যেভাবে রোগ এবং ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করে আমাদের সুস্থ রাখে, এই ন্যানোবটগুলিও শীঘ্রই তা করতে সক্ষম হবে। এবং নিকট ভবিষ্যতে এসব ন্যানোবোটের মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই কেমোথেরাপি দেয়া যাবে। ন্যানোবটের আকার চিন্তা করতে গেলেও অবাক হতে হয়। ২ কোটি ৫০ লক্ষ ন্যানোমিটারে এক ইঞ্চি, আর এই একেকটি ন্যানোবটের আকার মাত্র কয়েকশ ন্যানোমিটার।
২. মেলানোমা-ডিটেক্টিং মেশিন-
স্কিন ক্যান্সারের সবচাইতে মারাত্মক রূপ হলো মেলানোমা। অনেক সময় চিকিৎসকরা মেলানোমা সন্দেহে অস্বাভাবিক দেখতে শরীরের আঁচিল বা তিলের বায়োপসি করে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই এসব তিল বা আঁচিল ক্ষতিকর থাকে না। আর তাছাড়া বায়োপসির মাধ্যমে শরীর থেকে কোষ কেটে বাদ দেয়ার পদ্ধতি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং এর ফলে শরীরে দাগ থেকে যায়। তাই এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় বায়োপসির সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্যে মেলা সায়েন্সেস (MELA Sciences) নামের একটি প্রতিষ্ঠান মেলাফাইন্ড (MelaFind) নামের একটি ডিভাইস তৈরি করেছে।
এই ডিভাইসটির সাহায্যে রোগীর ত্বকের ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলি মাল্টি-স্পেক্টেরাল অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের আরো ভালো ভাবে ক্যান্সার শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। ডিভাইসটি একেকটি ছবিকে এর ডাটাবেজে থাকা মেলানোমা এবং অন্যান্য ত্বকের ক্যান্সারের আরও ১০,০০০ ডিজিটাল চিত্রের সাথে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করে। এভাবে একদিকে যেমন রোবট প্রযুক্তির সাহায্যে মেলাফাইন্ডের মতো ডিভাইস তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে এই রোগের ব্যাপারে প্রচুর ডেটা পাওয়ায় মেলানোমা গবেষণাতেও অগ্রগতি সম্ভব হচ্ছে।
৩. মিস্টার রোবট, এমডি-
টেলিমেডিসিন সেবার বদৌলতে দুর্গম যেসব জায়গায় আগে সেবা দেয়া সম্ভব হতো না এখন সেখানেও উন্নত সেবা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে স্কাইপ-এর মতো বিভিন্ন ভিডিও চ্যাটিং প্রযুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসকরা সহজেই সরাসরি রোগী দেখতে পারছেন। কিন্তু রোবোটিক্স প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। অত্যাধুনিক মেডিকেল রোবটগুলি এখন হাসপাতালের হলওয়েতে ঘুরে বেড়াতে পারে এবং ঠিক মানুষের মতোই রুটিন অনুযায়ী রোগীর দেখাশোনা ও চেক আপ করতে পারে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অনুমোদিত কিছু ‘রিমোট প্রেজেন্স’ রোবট রয়েছে, যেগুলি টু-ওয়ে ভিডিও স্ক্রিনের মাধ্যমে রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে। এতে করে একজন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবকদের সম্পূর্ণ একটি দল যেকোনো স্থান থেকেই রোগীর পাশে উপস্থিত থেকে সামনাসামনি চিকিৎসা দিতে পারেন।
৪. বেস্টিক-
উদ্ভাবক স্টেন হেমিংসন তার নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে একটি সহায়ক প্রযুক্তির প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। আর সেই সূত্র ধরেই আবিষ্কার করেন ‘বেস্টিক’ নামের একটি রোবোটিক আর্ম বা বাহু। রোবটটির হাতে একটি চামচ ধরা থাকে, এবং প্লেট থেকে কী খাবে বা কখন খাবে, তা এর ব্যবহারকারী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। বেস্টিক-এর ব্যবহারকারীই সম্পূর্ণ ভাবে রোবটটি নিয়ন্ত্রণ করেন। এতে অনেকগুলি বাটন থাকে এবং ফুট কন্ট্রোলস থাকে, যার মাধ্যমে পা দিয়ে রোবটটি কন্ট্রোল করা যায়। এতে একটি জয়স্টিক থাকে এবং ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী আরও কিছু ডিভাইসও সংযুক্ত থাকতে পারে।
৫. প্যারো রোবটের সাহায্য শিশুদের চিকিৎসা-
থেরাপিস্টরা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন যে ‘ডেভেলপমেন্টাল ডিজাবিলিটি’-তে আক্রান্ত শিশুরা অ্যানিম্যাল থেরাপিতে বেশ সাড়া দেয়। দুর্ভাগ্যক্রমে জীবিত প্রাণীদের মাধ্যমে থেরাপির কিছু সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে এই পদ্ধতিতে থেরাপি চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর। এর যথাযথ একটা সমাধান নিয়ে এসেছে ‘প্যারো’। এই রোবটকে দেখলে মনে হয় পুতুল, কিন্তু এগুলি একদম আসল সিল প্রাণীর মতোই আচরণ করে। এই পশমওয়ালা নরম সিল প্রাণীগুলি নিজেদের নাম শিখতে পারে, চোখের পলক ফেলতে পারে এবং শিশুদের যোগাযোগের ভিত্তিতে এরা এদের মুড প্রকাশ করে থাকে।
বিশ্বের মঙ্গলের জন্যে রোবটিক্সের যত উদ্ভাবন, তার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় এর ব্যবহারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজকের লেখায় আলোচনা করা এই ৫টি উদ্ভাবন বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, আগামিতে রোবোটিক্স প্রযুক্তি এর মাধ্যমে চিকিৎসাসেবায় বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে।