মেশিন শব্দের অর্থ যন্ত্র। থ্রি-ইডিয়টস মুভি যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয় আমির খানের সেই মেশিন এর ডেফিনিশন দেয়ার সিনটা মনে আছে। মেশিন বা যন্ত্র হল এমন একটি সিস্টেম যেখানে এক বা একাধিক অংশ/Parts মিলে একটি সুনির্দিষ্ট কাজ করে। বাসার সিলিং এ লাগানো ফ্যান-সুইচ দিলে চালু হয়-ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখে। কম্পিউটার এর মাউস ক্লিক করলেই প্লে করা যায় একটি ভিডিও। এরকম সলিড এবং ভারচুয়াল পার্টস এর সমন্বয়েও গড়ে ওঠে একটি কমপ্লেক্স মেশিন। ভারচুয়াল পার্টস বলতে সফটওয়্যার এবিং আপ্লিকেশন এগুলোকে বোঝায়। মেশিন লার্নিং হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সেয়র একটি বিশেষ ধরণের সাবফিল্ড। এটা এমন এক ধরণের প্রসেস যেটা কোন মেশিন বা সফটওয়্যারকে কোন কিছু নিজে নিজে শিখতে সাহায্য করে আর বেশি আপডেট হতে সাহায্য করে। এই মহামারীতে ঘরে বসে সময় কাটাতে আপনি প্রতিদিন কোন না কোন কাজে ইউটিউব ব্রাউজ করে থাকেন। সাধারণ ইউটিউবের হোমপেজে গেলেই দেখতে পান আপনার পছন্দ মত গান, নাটক, মুভি সবই হোম পেজে এসে হাজির। তাই না! আবার দেখা গেলো অরিজিৎ সিং এর গান প্লে করলেন। দেখবেন সাজেশন লিস্টে একটার পর একটা তার গান। কিভাবে সম্ভব?! ইউটিউবও পুরো মানুষের মাথার মতো আচরণ করে। অন্যদিকে অনলাইন মার্কেট প্লেস গুলোতে একই ধরণের অবস্থা চোখে পড়ে। একটা পণ্য তে ক্লিক করার সাথে সাথে দেখবেন এই রিলেটেড সব পণ্য হাজির। গোলকধাঁধায় পড়ে যাবেন।
আপনি নিশ্চয়ই ফেসবুক ব্যবহার করেন। এবং অবশ্যই ফেসবুক মেসেজ চেক করেন। তো একদিন চেক করতে গিয়ে দেখলেন স্প্যাম মেসেজ! মানে আপনি খেয়াল করেছেন যে ফেসবুকে একটা Spam নামক ফোল্ডার থাকে যেখানে স্প্যাম টেক্সট গুলো জমা হয়। যে প্রশ্নটা প্রথমেই মাথায় আসে তা হচ্ছে এত মেসেজ এর মধ্যে কিভাবে স্প্যাম বাছাই করা হয়! ফেসবুক প্রতিটা আইডির জন্য একজন করে বাছাইকারী নিয়োগ দিয়ে রাখেনি। এত জনবল তো ফেসবুকের নেই। তাহলে কিভাবে!
উপরের ঘটনাগুলো আমাদের খুব পরিচিত। প্রতিদিনই আমরা কমবেশি এসব জিনিসের সম্মুখীন হই। হয়তো আমরা জানতে চেষ্টা করি না এসব কিভাবে হয় এবং কেন হয়! এই মেশিন লার্নিং কে আমরা মোটামুটি আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করতে পারি। প্রশ্ন হল কিভাবে?
মেশিন লার্নিং প্রসেস-
ইউটিউব কিংবা দারাজ সাইটে আপনি যেসব পণ্য কিংবা লিংকে ক্লিক করেছেন সেসব টপিক ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে আপনার পছন্দ অনুমান করতে পারে। আর এই অনুমানের উপর ভিত্তি করেই আপনাকে বিভিন্ন সাজেশন সে দিয়ে থাকে। যারা আপনার রুচি/ পছন্দ বোঝে। আর এই সমগ্র প্রসেস অর্থাৎ কম্পিউটারকে মানুষের মতো করে চিন্তা করার জন্য মেশিন লার্নিং। মেশিন লার্নিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি উপসেট। মেশিন লার্নিং হল নিজস্ব প্রোগ্রামগুলি শেখার এবং বিকাশ করার ক্ষমতা দিয়ে আচরণ এবং সিদ্ধান্তে মেশিনগুলিকে আরও মানব-সদৃশ করার অধ্যয়ন। এটি সুস্পষ্ট প্রোগ্রামিং নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি একই ধরণের মেশিনের অভিজ্ঞতা এবং তার ডাটার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয় এবং উন্নত হয়। এই ডেটাতে মেশিনগুলিকে প্রশিক্ষণের জন্য এমএল মডেল তৈরি করতে বিভিন্ন অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। যখন কোন একটা সমস্যার সমাধানের জন্য প্রোগ্রামিংয়ের মাধমে এমন একটা অ্যালগরিদম ইমপ্লিমেন্ট করানো হয় যাতে কম্পিউটার নিজেই পরিবেশ এবং পূর্বের ঘটনা থেকে শিখতে পারে তখন এটাই মেশিন লার্নিং।
মেশিন লার্নিংকে বিশেষ চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়-
১. Supervised Learning
২. Unsupervised learning
৩. Semi-Supervised learning
৪. Reinforcement learning
মেশিন লার্নিং কে একটি উচ্চতর ক্যাটাগরির বিজ্ঞান বলা যেতে পারে যা প্রকৃতপক্ষে কোন মেশিনকে সকল প্রকার সম্ভাব্য কন্ডিশন অ্যানালাইসিস করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে সহায়তা করে। যেমন আমরা যদি কোন মেশিনকে পূর্বগঠিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের ডাটা দেই, তাহলে মেশিন লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করে মেশিনটি আমাদের দেওয়া ডেটা এনালাইসিস করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের অবস্থান,প্রকৃতি ইত্যাদির পূর্বাবাস জানাবে। আমাদের আর বারবার করে ডাটা ইনপুট দিতে হবে না ও নিজেই নিজের প্রোগ্রামের সাহায্যে আগের ডেটা এনালাইসিস করে বর্তমান ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের অবস্থান, প্রকৃতি দেখে আমাদের বলে দিবে বর্তমান অবস্থা এবং আগামীতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কতটা সবল বা দুর্বল হবে।
কিভাবে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী-
আজকাল আমরা সবাই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জানি। যারা জানেননা তারাও ‘কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা’ শব্দটি দেখে আন্দাজ করতে পারছেন ব্যাপারটা কি। আমরা সবাই মোটামুটিভাবে রোবটের কথা জানি। রোবট মানুষের মত হাটাহাটি করে, কাজ করে। আবার কথা বার্তাও বলে। রোবটের এসব মানুষের মতো আচরণ করার ‘বুদ্ধি’ কেই বলা হয় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। তবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা যে শুধু রোবটেরই থাকে সেটা নয়। ওয়েবসাইট, মোবাইল, বিভিন্ন সফটওয়্যার ইত্যাদিতেও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা থাকে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার পরিধি অনেক বিশাল। আর সেই পরিধির একটা অংশ হচ্ছে মেশিন লার্নিং।
এখন যুগ পাল্টেছে। সব কিছুতে এসেছে প্রযুক্তি পাথরের ছোঁয়া। টেলিভিশনের সাদা কালো পর্দা তারপর রঙিন পর্দাকে ছাপিয়ে এখন কম্পিউটার পুরোটা আসন পাকা করে বসেছে। কিন্তু আমরা কি জানি যে কম্পিউট একটি বোকা যন্ত্র! আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কম্পিউটার নিজে থেকে কিছু করতে পারেনা। আপনি, আমি কিংবা যারা কম্পিউটার নিয়ে ভাবে অথবা কম্পিউটারের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা তথা প্রোগ্রাম লিখেন, তাদের নির্দেশনা মেনেই কম্পিউটার বিভিন্ন জটিল জটিল গাণিতিক সমস্যা নিমিষেই সমাধান করতে পারে। আমাদের কম্পিউটার অনেক ফাস্ট এবং এটার প্রচন্ড রকমের প্রসেসিং ক্ষমতা তাকে কিন্তু কম্পিউটার কখনোই মানুষের মতো বুদ্ধি এবং কৌশল খাটাতে পারে না। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। কিছুদিন আগে রোবট সোফিয়াকে সৌদিআরব নাগরিকত্ব দিয়েছে। তাই মানুষ ও চাচ্ছে কম্পিউটার তাদের মতো করে ভাবুক, তাদের মত করে চিন্তা করুক এবং সমস্যা সমাধানে পূর্বলব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করুক। আর এই সমগ্র প্রসেস অর্থাৎ কম্পিউটারকে মানুষের মতো করে চিন্তা করার জন্য যাবতীয় সব কর্মকান্ডই কিন্তু মেশিন লার্নিং এর।
বর্তমানে জীবনের প্রায় প্রতিটি ফিল্ডে মেশিন লার্নিং এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রতিরক্ষা বাহিনী, আবহাওয়াবিদ..কে নেই! রাজনীতিবিদরাও ভোটারদের বিহ্যাভিয়ার অ্যানালাইসিস করতে ব্যবহার করছেন এই প্রযুক্তি। মঙ্গলে প্রানের ঝুঁকি নিয়ে আর মানুষ যাচ্ছে না। এখন রোবটকে পাঠানো হচ্ছে। মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সে মঙ্গলে ঘুরে ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে।
বিপদজনক যেকোনো পরিস্থিতি, যেমন- বোম্বা খুঁজতে অথবা নিষ্ক্রিয় করতে আর মানুষ যায় না, সেখানেও ভূমিকা রাখছে রোবট।
আপনি ভুল করে রুমের লাইট, এসি সব কিছু অন করে অফিসে চলে গিয়েছেন। অটোমেটিক সেগুলোর অবস্থা বুঝে অফ হয়ে যাবে। সেখানেও অবদান রাখতে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। অথবা ধরুন আপনার বাসায় চোর আসছে। সিসি টিভি যদি মেশিন লার্নিং থাকে তবে সাথে সাথে আপনাকে চোরের ইনফরমেশন পাঠিয়ে দেবে।
মেশিন লার্নিং এর একটি প্রয়োগ হল রোগ এবং অসুস্থতা নির্ণয় করা। মেশিন লার্নিং এর অন্তরভুক্তির সাথে সাথে রেডিওথেরাপি আরও ভাল হয়ে উঠছে।ক্লিনিকাল ট্রায়াল গুলিতে ফলাফল সম্পূর্ণ করতে এবং বিতরণ করতে অনেক সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়। মেশিন লার্নিং ভিত্তিক ভবিষ্যৎ বাণী মূলক বিশ্লেষণ প্রয়োগ করা এই কারণগুলো উন্নতি করতে পারে এবং আরও ভাল ফলাফল দিতে পারে। মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি অনেক প্রাদুর্ভাবের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা মহামারীর প্রকোপ এর পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।