বর্তমান সময়ে কল্পনা বা সায়েন্স ফিকশন থেকে আসা অনেক ধারণাই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। এখন আমাদের হাতে অসংখ্য প্রযুক্তি আছে এবং যখনই নতুন কোনো প্রযুক্তি আসছে, তখন সেসব প্রযুক্তির মধ্যে সংযোগ বের করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছি আমরা। আর এভাবেই নতুন আরো প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে।
‘মেটাভার্স’ হচ্ছে এমন সব নতুন চিন্তা ও প্রযুক্তির সংকলন। যদিও প্রযুক্তিটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তবে নতুন কী কী প্রযুক্তি ভবিষ্যতে এর সাথে যুক্ত হবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারবো না।
সম্প্রতি মেটাভার্স-এর ধারণা অনেক বেশি আলোচনায় এসেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করা প্রায় সব মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মেটাভার্স নিয়ে কথা বলছেন। অনেকের মতে, মেটাভার্স হচ্ছে ইন্টারনেটের বিকাশের পরবর্তী ধাপ বা পর্যায়। আর এটাই হবে বাস্তব এবং ভার্চুয়াল দুনিয়ার মধ্যে সংযোগ তৈরির সেতু।
যদিও সম্ভাবনার তুলনায় ‘মেটাভার্স’ ভবিষ্যতে কতদূর পর্যন্ত যাবে বা কোন দিকে যাবে, সেটা বলার সময় এখনও হয়নি। তবে আগামি বছরগুলিতে আসা নতুন সব প্রযুক্তি এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে মেটাভার্স বিস্তারের সম্ভাবনা আরো বাড়বে। যেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে, তা হলো ‘মেটাভার্স’-এর মতো জটিল এবং পরস্পর সম্পর্কিত প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজন একটা শক্তিশালী অবকাঠামো।
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, ভিআর, এআর, এমআর এবং ভিডিও কনফেরেন্স-এর মতো টুলের সাহায্যে এখন অনলাইনে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করার অভিজ্ঞতা বাস্তবের মতোই হয়ে যাচ্ছে। আর ভবিষ্যতেও মেটাভার্স যে মানুষকে কত সহজে আকর্ষণ করতে পারে, সে ব্যাপারে চলমান মহামারীতে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই ধারণা নেয়া যায়।
কোভিড-১৯ সংকটের কারণে অনলাইনে কাজ এবং যোগাযোগ করার চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। অনলাইনে যোগাযোগের প্রয়োজন যে আগে ছিল না বিষয়টা তেমন না। তবে কোভিড-১৯ এর মতো সাম্প্রতিক ঘটনায় এই অনলাইনে কাজ এবং যোগাযোগের মাত্রা হঠাৎ করেই বেড়েছে।
গেমিং দুনিয়ায় ‘মেটাভার্স’-এর মতো প্রযুক্তি বিদ্যমান ছিল আগেই। ফোর্টনাইট, মাইনক্রাফট এবং রোবলক্স-এর মতো গেমে ভার্চুয়াল উপায়েই অন্যদের সাথে যোগাযোগ করা যেত। গেমিং খুবই বর্ধনশীল একটি শিল্প। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গেমিং-এর বাজার ২০২৬ সালের মধ্যে ৩১৪.৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবার, মানুষ কেবল গেমস খেলতেই পছন্দ করে না, অন্যদের খেলা দেখতেও পছন্দ করে। গেমস খেলতে গিয়ে বা অন্যদের খেলা দেখতে গিয়ে সবাই এখন এখানকার মজাদার কার্যকলাপ উপভোগ করে। গেমস খেলতে গেলে নিজেদের চরিত্র বা ‘অ্যাভাটার’ হয়েই খেলতে হয়। ফোর্টনাইট এবং রোবলক্স-এর মতো অনেক গেমস এখন ভার্চুয়াল ইভেন্টেরও আয়োজন করছে। আর সেসব ইভেন্টে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কয়েক লক্ষও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
গেমিং শিল্পে এখনো পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফর্ম-এর মধ্যে সংযোগ দেখা যায়নি। তবে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো একদিন রোবলক্স-এর কোনো চরিত্র সহজেই ফোর্টনাইট-এ ঘুরতে যেতে পারবে। মেটাভার্স-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে এমনই সংযোগনির্ভর এবং পরস্পরের সাথে যুক্ত একটি জগৎ তৈরি করা। তবে ভার্চুয়াল এই দুনিয়া কখনোই বাস্তবতাকে সরাতে পারবে না। বরং বাস্তবতায় নতুন একটি মাত্রা যুক্ত করবে মেটাভার্স।
‘মেটাভার্স’-এর মতো মাল্টি-ডাইমেনশনাল বা বহুমাত্রিক স্পেসের চাহিদা এখন সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফেসবুক। প্রতিষ্ঠানটি আগামি ৫ বছরের মধ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কোম্পানি থেকে রিব্র্যান্ড করে নিজেদের মেটাভার্স কোম্পানিতে রূপান্তর করার পরিকল্পনা করছে।
মাইক্রোসফট এবং অন্যান্য বড় বড় টেক প্রতিষ্ঠানও এই মিছিলে যোগ দিচ্ছে। আগামি কয়েক বছরে এসব প্রতিষ্ঠান কী নিয়ে আসবে, তা জানার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করে আছেন। কিন্ত সবাই আশা করছেন যে, এর ফলে এমন একটি বিকেন্দ্রিত কমিউনিটি গড়ে উঠবে, যেখানে কেবল বড় বড় কোম্পানির হাতে সব নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তবে যেহেতু সবাই এই সেক্টর থেকে লাভবান হতে চাচ্ছে, তাই এটা করা বেশ কঠিনই হবে।
সম্প্রতি নতুন একটা বিকেন্দ্রিত বা ‘ডিসেন্ট্রালাইজড’ থ্রি-ডি কমিউনিটি তৈরি হয়েছে, যার নাম ‘ডিসেন্ট্রাল্যান্ড’। এই থ্রি-ডি কমিউনিটি হলো বিশেষ ধরনের একটি মাল্টিভার্স, যাতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব মাল্টিভার্স-এ এখন এনএফটি, অর্থাৎ ‘নন ফাংজিবল টোকেন’ অনেক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সময়ের সাথে সাথে এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, প্রযুক্তির কারণে আমাদের আচরণ ও মূল্যায়নের অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। কিছু ফ্যাশন হাউজ এখন মাল্টিভার্সের অ্যাভাটারের জন্য ভার্চুয়াল জামাকাপড় পর্যন্ত বাজারে এনেছে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে বিভিন্ন শিল্পের কাজ করার প্রচুর সম্ভাবনা আছে মাল্টিভার্স-এ। মাল্টিভার্স-এ ভালো এক টুকরো জমির দামই কয়েক লাখ ডলারে উঠে যাচ্ছে।
যেকোনো উদ্ভাবনের খারাপ দিকও থাকে সব সময়। ফলে এখনই এটা বলা কঠিন যে, মেটাভার্স প্রযুক্তি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য ভালো নাকি খারাপ ফলাফল বয়ে নিয়ে আসবে। কিন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে কীভাবে এই প্রযুক্তিগুলি এগিয়ে যাচ্ছে এবং আরো নতুন কোন কোন বিষয় এর সাথে যুক্ত হচ্ছে।