2020 সালে অনলাইনে ভাইরাল হওয়া একটি ক্লিপে দেখা গিয়েছে একজন কোরিয়ান মা তার মৃত(২০১৬) মেয়েকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছে এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে। সেই সময় এই ভিডিও প্রায় 13 মিলিয়নের বেশি ভিউ হয়েছিল। ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে এই ধরণের আবহ তৈরি অসম্ভব কিছু নয়।
যদি আপনি ফুটবল পছন্দ করেন, সেক্ষেত্রে আপনার তাৎক্ষণিক বিনোদনের জন্য সবচেয়ে ভাল একটি গেম হচ্ছে পেনাল্টি শুট। কেমন হয় যদি এটি বাস্তবে মতো করে খেলা যায়? বাস্তবে যেমন আপনি কিক করার পর গোল হয় তেমন যদি অনলাইনেও হয় তাহলে কি খুব বেশি আশ্চর্য হবেন? হ্যাঁ, এই সবই ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে সম্ভব৷
আজকে আমরা কথা বলবো ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কি, কিভাবে কাজ করে এই সব নিয়ে৷
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি?
কম্পিউটার জেনারেটেড সিমুলেশনের মাধ্যমে থ্রী-ডাইমেনশনাল আবহ তৈরি করে যে প্রকৃয়ায় অবাস্তব বিষয়কে দৃশ্যমান করে তোলা যায়, তাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বলে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে এমন সব কৃত্রিম বিশ্ব তৈরি করা সম্ভব, যা দেখে মনে হয় একেবারে বাস্তব। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কেউ যদি ইচ্ছে করে, কন্টেন্টের মধ্যে চারপাশে কি ঘটছে তা দেখবো, সেটিও সম্ভব। অর্থাৎ ইউজার চাইলে ভিআর কন্টেন্টের উপরে, নিচে, ডানে, বামে যেখানে ইচ্ছে সেখানে তাকাতে পারে। এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’র রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার। যেমন গেমিং, সেলস, অ্যাডুকেশন, ট্রেইনিং এবং ডাক্তারদের ব্যয়বহুল সার্জারি প্রশিক্ষনেও ব্যবহার করা সম্ভব।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি মধ্যে পার্থক্য-
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তে প্রত্যেকটি জিনিস তৈরি করার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ কেউ যদি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’র কোন কনটেন্ট দেখে থাকে, সে কনটেন্ট এর প্রত্যেকটা পার্টি কিন্তু ক্রিয়েটেড। কিন্তু অগমেন্টেড রিয়েলিটি একটু পার্থক্য আছে। সেটি হচ্ছে অগমেন্টেড রিয়েলিটি ভার্চুয়াল অংশ থাকবে সেই সাথে আমাদের সাধারণ পৃথীবি-ও থাকবে।
আপনারা হয়তো অনেকেই পোকেমন গো এর কথা শুনেছেন। পোকেমন কে খুঁজে পেতে আমাদের শেষ ডেস্টিনেশন যেতে হয়। সেখানে গিয়ে আমরা দেখতে পাই পোকেমন এর একটি ত্রিমাত্রিক অবয়ব। আমরা আমাদের লোকেশন এর মধ্যে পোকেমন কে দেখতে পাই। রাস্তা বা রাস্তার মধ্যে যত অবজেক্ট আছে সেই সব এবং পোকেমন এর অগমেন্টেড ভার্সন উভয় আমরা একই স্ক্রিনে দেখতে পাই। এটিকে বলা হয় অগমেন্টেড রিয়েলিটি।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কিছু ব্যবহার-
ভার্চুয়াল রিয়েলিটির রয়েছে বহুমাত্রিক ব্যবহার চলুন জেনে নেওয়া যাক চমৎকার পাঁচটি ব্যবহার সম্পর্কে-
মিলিটারিতে ভিআর-
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য উভয় দেশ তাদের মিলিটারিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার নিশ্চিত করছে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হয় আর্মি, এয়ার ফোর্স, ম্যারিন ও কোস্ট গার্ড এই সমস্ত ব্রাঞ্চে। ভিআর-কে ব্যবহার করে সৈন্যদেরকে কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেনিং দেয়া সম্ভব।
কারণ ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে অডিও এবং ভিডিও ভিজুয়াল দুটো রয়েছে। সেই সাথে অনেক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সেটআপ রয়েছে যেখানে নির্দিষ্ট কিছু অনুভূতিও সৃষ্টি করা সম্ভব। এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের ফলে যেমন খরচের বিষয়টি কমে এসেছে তেমনি সৈন্যদেরকে রিয়েল কমব্যাট ফেস না করে ভীষণ দারুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করা যায় যা আগে কখনো সম্ভব হতো না।
মিলিটারিরা এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে থেকে মূলত ফ্লাইট সিমুলেশন, ব্যাটলফিল্ড সিমুলেশন, মেডিকেল ট্রানসলেশন, এবং ভার্চুয়াল বুটক্যাম্প সহ অন্যান্য বিষয়ে। এছাড়াও যারা যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে সেই সকল সৈন্যদেরকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে VRET(Virtual Reality Exposure Therapy) নামক এক ধরনের থেরাপি দেয়া হয়।
খেলাধুলায় ভিআর-
ভার্চুয়াল রিয়ালিটি স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রিতে পুরোপুরি রেভ্যুলেশন সৃষ্টি করতে পেরেছে। বর্তমান সময়ে কোচ এবং প্লেয়ার নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে ভিআর ব্যবহার করে নিজেদের স্কিল কে আরো শারপ করে তুলেছে দিন দিন। যেকোনো ধরনের মুভমেন্টকে ত্রিমাত্রিক ভাবে বর্ণনা করার ফলে সহজেই কোন প্লেয়ার তার কোচের নির্দেশনা বুঝতে পারে। কোচও একইভাবে তার শিশ্যদের কৌশলগুলো রপ্ত করানোর জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে।
এইতো গেল খেলাধুলায় প্রশিক্ষণের ব্যাপার। বর্তমানে আরও একটি বড় ধরনের পরিবর্তন স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রিতে হতে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে ব্রডকাস্টিং। ফলাফল, এখন যে কেউ ঘরে বসে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে স্টেডিয়ামে খেলা দেখার মতো করে সবকিছু উপভোগ করতে পারবে । যা আগামী দিনের স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রির ব্রডকাস্টিং পুরোদমে চেঞ্জ করে দিবে।
মেন্টাল হেলথ-
রোগী যখন হাসপাতাল বেড়ে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে, থাকে তখন তার সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি মেন্টাল চিকিৎসার দেওয়া প্রয়োজন পড়ে। মানসিক সাপোর্ট দেয়ার জন্য হাসপাতাল আবহাওয়ার মতো জঘন্য আবহাওয়া পরিবর্তন হওয়া দরকার। কিন্তু একই সাথে সাধারণ টিটমেন্ট করা দরকার। দুটো কি একই সঙ্গে করা সম্ভব?
হ্যাঁ, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে যে কোনো রোগীকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়া সম্ভব। ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর মানসিক অবস্থা বুঝে সে অনুযায়ী সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে উপযুক্ত আবহ তৈরি করে রোগীকে মানসিক সাপোর্ট দেয়া সম্ভব। এতে করে একই বিছানায় রেখে রোগীর সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎস করা সম্ভব।
মেডিকেল ট্রেনিং-এ ভিআর-
মেডিকেল চিকিৎসা প্রশিক্ষণ পদ্ধতি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল শিক্ষা পদ্ধতি গুলোর একটি। এখানে শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য মানুষের মৃত লাশ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। যা সবসময় সব জায়গায় সঠিক পরিমাণে পাওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। এছাড়াও যদি একটি লাশ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, সেখানে শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে বিষয়টি ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ কম থাকে।
ফলে যা শেখার তা তাৎক্ষণিকভাবে শিখে নিতে হয়। কিন্তু সব সময় তো তাৎক্ষণিকভাবে শিখে নেয়া যায়না। এক্ষেত্রে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে মেডিকেল ট্রেইনিং-কে আরো নিপুন করে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা যায়। এক্ষেত্রে দুটো লাভ হয়। প্রথমত, খরচ অনেকাংশে কমে আসে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং পরবর্তীতে পড়াটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয়। যা তাদের বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে সহায়তা করে।
শিক্ষায় ভিআর –
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শুধুমাত্র মেডিকেল ট্রেনিং কিংবা স্পোর্টসে নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রও বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে অনেক প্রিমিয়াম কোর্স পাওয়া যায় যেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে অনেক উন্নত মানের শিক্ষা দিতে পারবে বলে তারা বলে থাকে। যেকোনো কঠিন বিষয় কে যদি ভিজুয়াল রূপ দেয়া যায় তাহলে তা আর কঠিন থাকেনা।
শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় কিছু বিষয় বুঝে উঠতে পারেনা। কিন্তু সেই বিষয়গুলো যদি তাদেরকে ভিজুয়াল মাধ্যমে দেখানো যায় তাহলে তারা সেটি খুব সহজে মনে রাখতে পারে এবং বুঝতে পারে।
আমরা টিভিতে যে কার্টুন দেখি, সেগুলো কিন্তু ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। বিশেষ করে মিনা কার্টুনের কথা যদি আমরা সবাই কমবেশি জানি। এই মিনা কার্টুনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনোদনের মাধ্যমে শিশুদেরকে শিক্ষিত করে তোলা এবং সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
বিজ্ঞানের কিছু বিষয় আছে যেগুলো বইয়ের লেখায় সঠিকভাবে কল্পনা করা যায় না। যেমন ধরুন মাইটোকনড্রিয়া, নিউক্লিয়া্ কোষ, ব্লাড ইত্যাদি। এগুলো আমরা সবাই পড়ে এসেছি। কিন্তু অনেকে আমরা বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে পারি না কারণ আমাদের ভিজুয়াল করার ক্ষমতা সবার সমান নয়।
এই বিষয়টি যদি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায় তাহলে সবাই খুব সহজে কনসেপ্টটা ধরতে পারে। আপনার যদি এখনও ‘নিউক্লিয়াস কোষের বাইরে থাকে না ভেতরে থাকে’ বা ‘রক্তের মধ্যে আসলেই কি এতগুলো উপাদান থাকা সম্ভব?’ এ ধরনের প্রশ্ন আসে তাহলে জাস্ট গুগলে ওই স্পেসিফিক বিষয়টি যদি সার্চ করেন। সাথে সাথে রিলিভ্যান্ট অনেক কন্টেন্ট পাবেন যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।