মস্তিষ্ক এবং মস্তিষ্কের বাইরের পরিবেশের একটি ডিভাইসের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার যে প্রযুক্তি, তার নামই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা বিসিআই। এটি ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস (বিএমআই) বা নিউরাল ইন্টারফেস নামেও পরিচিত। মানুষের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তির সাহায্যে পৃথিবীকে পরিবর্তনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে বিসিআই গঠনের জন্যে ৩টি উপাদান প্রয়োজন-
১. মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয় এবং বিপাকীয় কার্যক্রমকে রেকর্ড করার জন্য সুনির্দিষ্ট ইলেক্ট্রোড।
২. মস্তিষ্ক থেকে গৃহীত সিগনাল ব্যাখ্যা করার জন্যে একটি প্রসেসিং পাইপলাইন। এটি মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় সংকেত বাছাই করে সেখান থেকে দরকারি ধরনগুলির অর্থোদ্ধার এবং ফলাফল সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়।
৩. প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসারে কাজ করার মতো একটি কম্পিউটার। মস্তিষ্কের নির্দেশনা ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণযোগ্য অসংখ্য যন্ত্র রয়েছে। মানুষের কর্মদক্ষতাকে প্রতিস্থাপন, পুনর্বাসন, বৃদ্ধি, সহায়তা বা উন্নতকরণ, এই ৫টি উপায়ে এসব যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
মস্তিষ্কের কার্যক্রম পরিমাপের কৌশল-
কম্পিউটার ইন্টারফেস বা বিসিআই প্রযুক্তির প্রথম ধাপ হচ্ছে মানব মস্তিষ্ক থেকে প্রেরিত সংকেতগুলিকে সঠিকভাবে ধারণের ব্যবস্থা করা। এই ধাপটি সবচেয়ে জরুরি। কারণ এই ধাপেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির ব্যয়, সম্ভাব্য প্রয়োগের ক্ষেত্র এবং জনগোষ্ঠীর কোন অংশের জন্যে এটি ব্যবহার করা যাবে, এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলির নির্ধারণ সম্ভব হয়। মস্তিষ্কের কার্যাবলি বোঝার ২টি পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমটি দেহের অভ্যন্তরে সেন্সর প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে আর দ্বিতীয়টি দেহের বাইরে সেন্সর স্থাপনের মাধ্যমে।
দেহের অভ্যন্তরে সেন্সর প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের স্থান-কাল ভিত্তিক অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব।
অর্থাৎ, আমরা একদম সুনির্দিষ্ট ভাবে কোথায়, কখন, কীভাবে মস্তিষ্কের স্নায়বিক কার্যকলাপ ঘটছে সেটি জানতে পারি। তবে এই পদ্ধতিটি যথেষ্ট ব্যয়বহুল এবং দেহের ভেতর সেন্সর প্রতিস্থাপনে জটিল সার্জারির প্রয়োজন হয়। সার্জারি পরবর্তী সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকে।
দেহের বাইরে স্থাপিত সেন্সরের সাহায্যে ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি বা ইইজির দ্বারা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কর্মকাণ্ড, ম্যাগনেটোএনসেফালোগ্রাফি(এমইজি) দ্বারা চৌম্বকীয় ক্রিয়া এবং স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কার্যকরি ইনফ্রারেড রশ্মির স্প্রেকট্রোস্কপির সাহায্যে মস্তিষ্কের বিপাকীয় কার্যাবলী নির্ধারণ সম্ভব।
ইইজি-ভিত্তিক ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের স্নায়বিক প্রক্রিয়া-
মাথার খুলির ওপরের বিভিন্ন জায়গায় ইলেক্ট্রোড বসিয়ে মস্তিষ্কের ভেতরের বৈদ্যুতিক কার্যক্রম নিরূপণ সম্ভব। এই কাজে কমপক্ষে ২টি ইলেক্ট্রোড ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে থেকে একটা নির্দিষ্ট ইলেক্ট্রোডের সাপেক্ষে বাকি ইলেক্ট্রোডগুলোর ভোল্টেজ পরিমাপ করা হয়।
বিভিন্ন ইলেক্ট্রোডের ভোল্টেজের পার্থক্য অনুসারে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার পরিমাপ করা হয়। মস্তিষ্কের একটা সুনির্দিষ্ট স্থানের বৈদ্যুতিক কাজের পরিমাপ পাওয়ার জন্যে ইলেক্ট্রোডগুলিকে মস্তিষ্কের ঐ সুনির্দিষ্ট জায়গার যতটা সম্ভব কাছাকাছি স্থাপন করতে হয়। ফলে মাথার খুলির বিভিন্ন স্থানে ইলেক্ট্রোড রেখে বিভিন্ন রকমের স্নায়বিক কাজের পরিমাপ পাওয়া যায়।
ইইজির মাধ্যমে মস্তিষ্কের সক্রিয় কার্যকলাপের বিভিন্ন ধরন নির্ণয় করা সম্ভব। বাইরের পরিবেশের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্দীপনা ছাড়াই মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয় ভাবে যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সেগুলি মস্তিষ্কের স্বতঃস্ফূর্ত কাজ। অন্যদিকে, বাহ্যিক পরিবেশের কোনো সংবেদ, ঘটনা বা উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্তিষ্ক বিভিন্ন রকমের কাজ করে থাকে।
ইইজি ভিত্তিক ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের জন্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ-
ইইজি ভিত্তিক তথ্য সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
প্রকৃতপক্ষে, একটি ডিভাইসকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে ইইজি-ভিত্তিক বিসিআই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রোডগুলির মাধ্যমে নির্ণীত ভোল্টেজের মানকে ডিজিটাল কমান্ডে পরিণত করতে হয়। মস্তিষ্ক এবং ডিভাইসের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসের এমন একটি অ্যালগরিদমের প্রয়োজন হয়, যেটি মস্তিষ্কের সংকেতকে প্রসেস করতে পারে। একই সঙ্গে মস্তিষ্কের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে বের করে আনতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্ন চিনতে পারে। আর উপযুক্ত এআইয়ের মাধ্যমে এর সবই করা সম্ভব।
ইইজি-ভিত্তিক ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের প্রয়োগ-
কোনো দুর্ঘটনা বা অসুস্থতায় স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারানো ব্যক্তিরা বিসিআই ব্যবহারের মাধ্যমে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড চালাতে পারেন। যেমন হাঁটতে পারে না, এমন কেউ বিসিআই দ্বারা রোবোটিক হুইলচেয়ার চালাতে পারেন। অথবা বোবা কেউ মস্তিষ্ক-নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগের যন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।
২০০৯ সালে জারাগোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিসিআই নিয়ে গবেষণা করা একটি দল P300 নমুনার ভিত্তিতে বিসিআই নিয়ন্ত্রিত একটি হুইলচেয়ার উদ্ভাবন করেন।
সেখানে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদেরকে থ্রিডি পদ্ধতিতে এলোমেলো ভাবে তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কতগুলি ছবি দেখানো হয়। ছবিগুলির মধ্যে থেকে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে তাদের মনোযোগকে স্থির করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কয়েক সেকেন্ড পরেই হুইলচেয়ারের বিসিআই ব্যবস্থাটি ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া ও উদ্দীপনাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজে থেকেই সচল হয়ে ব্যবহারকারীদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থলে নিয়ে যায়।
বিসিআই এর মাধ্যমে দেহের হারানো কর্মক্ষমতাও ফেরত পাওয়া সম্ভব। পক্ষাঘাত আক্রান্ত অথবা স্নায়বিক আঘাতের কারণে হাত-পায়ের দুর্বলতায় ভোগা কেউ বিসিআই-এর বৈদ্যুতিক উদ্দীপনার মাধ্যমে নিজেদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
বিসিআই এর এই দুই ধরনের প্রয়োগের মাধ্যমে শারীরিক ভাবে অক্ষম বা দুর্বলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তার ব্যাপারে কাজ করা হয়। কিন্তু সুস্থ ব্যক্তিরাও বিসিআই দ্বারা উপকৃত হতে পারেন। অথচ মানুষের কর্মক্ষমতার উন্নয়ন বা সহায়তায় বিসিআই-এর এসব ভূমিকা এখনো তেমন আলোচিত নয়। কারণ, অক্ষম বা দুর্বল ব্যক্তিদের সহায়তায় এটি সহজে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও স্বাভাবিক মানুষের কর্মক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিসিআই-এর ব্যবহার নিয়ে নৈতিক আশঙ্কা ও বিতর্ক রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মুক্ত বিজ্ঞানচর্চার উদ্যোগের কারণে প্রতিনিয়ত আরো বেশি গবেষণাগার থেকে গবেষণাপত্র এবং গবেষণাসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে।
বর্তমানে তাই ইইজি রেকর্ডিংয়ের অত্যন্ত দামি যন্ত্রপাতি ছাড়াই বিসিআই ব্যবস্থার যান্ত্রিক অগ্রগতি এবং কার্যপদ্ধতির উন্নয়ন আরো বেশি সম্ভব হয়ে উঠছে।