বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গুলো হলো অ্যাপল এবং সামস্যাং। এই দুই প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও একটি স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানী যথেষ্ট ভালো ফাইট দিয়ে আসছিলো বেশ কয়েক বছর ধরে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন হুয়াওয়ে ছিলো এই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইউএসএ থেকে ব্যান এবং গুগলের সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর তাদের অবস্থান বেশ নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠান গুলোর পর সবচেয়ে সফল স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানীর নাম হলো বিবিকে ইলেকট্রনিক্স। এশিয়ান বাজারে এদের বেশ শক্ত অবস্থান রয়েছে বেশ দীর্ঘদিন ধরে। হয়তো আপনি বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এর নামও শুনেননি এখনও পর্যন্ত। কিন্তু তাদের সফল ব্রান্ড এবং সাব ব্রান্ড যেমন ওপো, ভিভো, রিয়েলমি, এবং ওয়ানপ্লাস, এর নাম নিশ্চই শুনেছেন।
বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স হলো চাইনিজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী, যারা দীর্ঘদিন যাবত বেশকিছু কনজিউমার ইলেক্ট্রনিক্স এর মার্কেটে অবস্থান করছে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে। তারা মূলত হেডফোন, ব্লু-রে প্লেয়ার, স্মার্টফোন সহ আরও নানারকম সার্ভিস প্রদান করার মাধ্যমেই বাজারে প্রবেশ করেছিলো এবং ধীরে ধীরে হয়ে ওয়ে স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানী।
আজকে আমরা আলোচনা করবো এই বিবিকে ইলেকট্রনিক্স নিয়ে। চলুন শুরু করা যাক-
বিবিকে ইলেকট্রনিক্স মূলত কারা?
বিবিকে ইলেকট্রনিক্স হলো মুলত চাইনিজ ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রি, যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৯০ সালে। ডুয়ান ইয়ংপিং হলেন এই বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ঐ সময়েও একজন সাক্সেসফুল বিলিয়নার ছিলেন গেইমিং কন্সোল ‘সাবুর’ এর মাধ্যমে। এই সাবুর ছিলো তখনকার সময় নিটেন্ডো-এর সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর। এরপর ১৯৯৫ সালে তিনি কোম্পানিটি ছাড়ার পর শুরু করেন বুবুগাও নামের প্রতিষ্ঠান যা পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে পরিণত হয় বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এ।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে প্রায় ১৭ হাজারেরও অধিক কর্মী। যদিও বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো সিডি, এমপিথ্রি, এবং ডিভিডি প্লেয়ার তৈরির মাধ্যমে। এছাড়াও তারা হাউজহোল্ড অ্যাপলাইয়েন্সও তৈরি করতো। এরপর ২০০৪ সালে টনি চ্যান এর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন ওপো। এই ওপো তখনও স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ করেনি। ওপো তখন ডিভিডি এবং ব্লু-রে প্লেয়ার তৈরি করতো।
বিবিকের হাত ধরে ভিভোর উত্থান-
ডুয়ান তখন একের পর এক সফল প্রতিষ্ঠান তৈরি করেই চলেছেন। যাত্রার এই পথে ২০০৯ সালে তিনি এবং শেন ওয়েই এর সাথে যৌথ ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ভিভো। তবে ২০০৯ সালে এবং এর পরবর্তী সালেও বিশ্ব ভিভোর কোন প্রকার স্মার্টফোন দেখেনি। ভিভো তাদের প্রথম স্মার্টফোন লঞ্চ করেন ২০১১ সালে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আল্ট্রা-স্লিম স্মার্টফোন তৈরি করা। এই ভিভো মার্কেট-এর ধরণ বুঝে বেছে নিলো মিডরেঞ্জের ফোন তৈরি করার পন্থা। কারণ তারা দেখলো এই বাজেটে তখন খুব ভালো স্মার্টফোন নেই।
অ্যাপল এবং সামস্যাং সহ অনেকে তখন হাই-রেঞ্জের স্মার্টফোন তৈরির প্রতিযোগীতায় জড়ালেও ভিভো মিডরেঞ্জকে টার্গেট করলো। যদিও ভিভোর মার্কেটে প্রবেশ করেছিলো মিডরেঞ্জকে টার্গেট করে, বর্তমানে তারা হাই-ফ্লাগশিপের দিকেও ঝুঁকেছে এবং মার্কেটে বেশ ভালো অবস্থান তৈরি করছে।
রিয়েলমির উত্থান-
স্মার্টফোন বাজারে মিডরেঞ্জ টার্গেট করলেও বেশ কিছুদিন যাবত শাওমির অস্বাভাবিক মার্কেট গেইনের কারণে বিবিকে একটু ঝেঁকে বসলো। তারা আরও অ্যাগ্রেসিভ ভাবে মার্কেটে ডমিনেট করার জন্য বাজারে নিয়ে আসলো রিয়েলমি। এই রিয়েলমি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কাই লি, যিনি পূর্বে ছিলেন ওপো ইলেকট্রনিক্স এর ভাইস প্রেসিডেন্ট, এর হাত ধরে।
তারা মূলত শাওমির জন্য সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর ছিলো। শাওমির বাজার বিশ্লেষণ করে আরও অ্যাগ্রেসিভ লেভেলের স্মার্টফোন তৈরি করে বেশ সাড়া ফেলেছিল। ফলস্বরূপ, তারা ২০১৯ সালে বেস্ট স্মার্টফোন অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলো।
ওয়ানপ্লাসের উত্থান-
বলা হয়ে থাকে ওয়ানপ্লাসের শুরু ডুয়ান-এর হাত ধরে হয়নি। তবে ডুয়ানের প্রতিষ্ঠান ওপো’র ভাইস প্রেসিডেন্ট পেটে লউ, এবং কার্ল পাই দুজন মিলে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ানপ্লাস। মূলত ওয়েস্টার্ন এবং ইউরোপে চাইনিজ স্মার্টফোনের ভালো সুনাম অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
কারণ কোন চাইনিজ স্মার্টফোন আইফোন, সামস্যাং-এর মত জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানে ফ্লাগশিপ লেভেলে কমপিট করতে পারছে না। এই গ্যাপটি যখন তারা খুঁজে পেলো তখন তারা এই প্রিমিয়াম মডেলের ওয়ানপ্লাস ওয়ান সিরিজ চালু করে। যদিও বর্তমানে তারা মিডরেঞ্জের বাজার দখলের জন্য নর্ড নামের আরেকটি মডেলের ফোন বাজারে নিয়ে এসেছে। অনেকটা আইফোনের এসই ভার্সনের আদলে তৈর তাদের এই মডেল।
গ্লোবাল মার্কেটে বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এর অবস্থান-
বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স একসাথে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাদের বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত আধিপত্ত বাড়ছে। বিশেষ করে ওয়েস্টে ওয়ানপ্লাস বেশ সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। মার্কিন বাজারে ফ্লাগশিপ হিসেবে অনপ্লাসের অবস্থান বেশ নজরকাড়ার মত। যা এর আগে কোন প্রকার স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দেখাতে পারেনি। ২০২১ সালের প্রথম কোয়াটারে ওয়ানপ্লাসের বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৪২৮ শতাংশ। গুগল পিক্সেলের মিডরেঞ্জের ফোন গুলোর সাথে বেশ ভালো পাল্লা দিচ্ছে এই ওয়ানপ্লাসের নর্ড ভার্সন গুলো।
এছাড়াও ওয়ানপ্লাস ইউরোপ-এর বাজারে ২ শতাংশেরও অধিক মার্কেট শেয়ার রয়েছে। যেহেতু ওয়ানপ্লাস শুধুমাত্র ফ্লাগশিপ লেভেলের জন্য বিখ্যাত, সেই তুলনায় এই ২ শতাংশও অনেক ভালো মার্কেটশেয়ার বলতেই হয়।
ওপো এবং ভিভোর ইন্টারন্যাশাল মার্কেটশেয়ার আরও বেশ দৃঢ়। বিশ্ববাজারে ২০২১ সালের প্রথম কোয়াটার অবধি ওপো’র মার্কেটশেয়ার ১১ শতাংশ। এছাড়াও ভিভোর রয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি মার্কেটশেয়ার গ্লোবাল মার্কেটে।
যেখানে অ্যাপলের মোট মার্কেটশেয়ার ১৭ শতাংশ ২০২১ সালের প্রথম কোয়াটার অবধি। সেখানে ওপো এবং ভিভো’র সম্মিলিত মার্কেটশেয়ার ২১ শতাংশ। যা অ্যাপলের মোট বিক্রির চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। এর মাধ্যমে বোঝা যায় আসলে গ্লোবাল মার্কেটে বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এর অবস্থান।
এছাড়া যদি আলাদা ভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে ওপো অ্যাপলের মোট মার্কেটশেয়ারের থেকে সামান্য পিছিয়ে।
ওয়ার্ল্ডের প্রথম সারির স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারারদের কথা বলতে গেলে এখন থেকে অ্যাপল, সামস্যাং, এবং হুয়াওয়ের পর বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স এর নাম নেয় যেতেই পারে।
এতকিছুর পরও কেন বিবিকে সম্পর্কে অনেকের অজানা-
যেহেতু ওপো, রিয়ালমি, ওয়ানপ্লাস এবং ভিভো’র মত জনপ্রিয় স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারারের পেরেন্ট কোম্পানী তাও বেশিরভাগ মানুষের এই কোম্পানীর ব্যপারে অজানা। এছাড়াও তাদের আরেকটি রিসেন্ট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আইকুউ(iQOO)।
এই সবগুলো প্রতিষ্ঠানের মিলে ওয়ার্ল্ড মার্কেটের প্রায় ১৯ শতাংশ শেয়ার দখরে ছিলো ২০২০ সাল নাগাদ। এছাড়াও বিবিকে ইলেট্রনিক্স ইন্ডিয়ার নাম্বার ওয়ান স্মার্টফোন সেলার ব্রান্ড। ইন্ডিয়াতে বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স এর মার্টেকশেয়ার প্রায় ৪৩ শতাংশ।
মূলত বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স সাব-ব্রান্ডের মাধ্যমে মার্কেটে অগ্রাসনের কারনে বিশ্বে সাব-ব্রান্ড গুলোই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তাদের এই মার্কেটিং পলিসির কারণে শাওমির মত প্রতিষ্ঠানকে তারা পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাদের বিশ্ববাজারে দিন দিন আরও শক্তভিত স্থাপন হচ্ছে।
বিবিকে’র ভবিষ্যত ভাবনা-
বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স শুধুমাত্র চায়নাতে মার্কেটে ডমিনেট করে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। কারণ তাদের চিন্তাভাবনা বিশ্ববাজারকে কেন্দ্র করে। যদিও সম্মিলিত ভাবে ইন্ডিয়ান বাজারে শাওমিকে পেছনে ফেলতে পেরেছে, তারপরও বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স এর চিন্তাভাবনা থাকবে এশিয়ার বাইরে কিভাবে আরও বেশি ডমিনেট করা যায়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে তাদের মার্কেট স্ট্র্যাটেজি নিশ্চই সবার নজর কাটতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে উড়ন্ত হুয়াওকে একটি মাত্র ব্যানের মাধ্যমে ধপাস করে গ্লোবাল মার্কেটের রেইস থেকে বের করে দিতে পেরেছিলো যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে বিবিকে ইলেক্ট্রনিক্স-এর চিন্তাভাবনা হয়তো আরও অনেক বেশি অগ্রসর। কারণ তারা মার্কেটে বেশ কয়েকটি সাব-ব্রান্ড নিয়ে অ্যাপ্রোচ করছে। এখনও পর্যন্ত বিশ্ববাজারে তাদের অবস্থান সন্তোষজনক না হলেও অতি দ্রুত তারা যে বেশ ভালো অবস্থান দখল করবে তা তাদের অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি দেখেই বলে দেয়া সম্ভব।