5G কি? বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি যে পরিবর্তন আনতে চলেছে
আপনি নিশ্চয় ইন্টারনেট থেকে কখনও না কখনও মুভি ডাউনলোড করে দেখেছে। একটি হাই-ডেফিনিশন(HD) মুভি ডাউনলোড করতে আপনার সর্বনিম্ন কত সময় লাগে একবার চিন্তা করে দেখুন। একটা সাধারণ অনুমান করলে বলা যায়, সর্বনিম্ন ৫-১০ মিনিট লাগে একটি বড় সাইজ এর মুভি বা ফাইল ডাউনলোড করতে। কিন্তু আমি যদি এটা বলি যে, নতুন যুগের নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি- ফাইভ-জি এর মাধ্যমে সেই একই ফাইল ডাউনলোড/ট্রান্সফার করতে আপনার সময় লাগবে মাত্র ৫ সেকেন্ড; তাহলে সেটা শুনতে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হবে । কিন্তু বাস্তবে, এরকমই কিছু যুগান্তকারী সুবিধা নিয়ে পৃথিবীর কিছু দেশ এবং শহরে চালু করা হয়েছে ফাইভ-জি প্রযুক্তি বা 5G -Network । চলুন প্রথমেই জেনে নেয়া যাক 5G টেকনোলজি কি এবং এটি কিভাবে কাজ করে।
মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যাবহার করিনি, এরকম মানুষ এখন পাওয়া যাবে না। মোবাইল ডিভাইস এ আমরা যে নেটওয়ার্ক বা ডাটা কানেকশন বব্যাবহার করি, সেটি একটি তারবিহীন বা Wireless নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক সিস্টেম-এ আমরা এখন যে সংযোগ ব্যাবহার করছি সেটি 3G/4G নেটওয়ার্ক। আমাদের ব্যবহৃত স্মার্ট ফোনে আমরা স্ক্রিনের সবার উপর 3G/4G লেখা ভেসে থাকতে দেখি। এগুলো হল নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ব্যাবহৃত প্রযুক্তির এক একটি জেনারেশন বা প্রজন্ম। সুতরাং, আপনি বুঝতে পারছেন, ফাইভ-জি হল এই প্রযুক্তির সর্বাধুনিক প্রজন্ম বা আপডেট। পঞ্চম প্রজন্মের এই প্রযুক্তি আগের 3G-4G সিস্টেম কে অনেক পেছনে রেখে, ইন্টারনেট ব্যবহার কে আরও সময়োপযোগী ও দ্রুত করবে এটাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
5G এর বিশেষত্ব–
দ্রুতগতির ইন্টারনেট – Slow-Internet; এই শব্দটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। আমরা বাসা-অফিস বা যাত্রা পথে যে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করি, সেখানে কোন ওয়েবসাইট ভিজিট করতে বা ইউটিউব-এ ভিডিও দেখতে গেলে সেটা লোড হতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। 5G প্রযুক্তি তে এরকম কোন বিষয় থাকে না। যেখানে আমাদের বর্তমান 4G নেটওয়ার্ক সেকেন্ডে সর্বোচ্চ 200MB স্পিড দিতে পারে, সেখানে ফাইভ-জি 1GBPS এর চেয়েও বেশী ইন্টারনেট স্পিড দিতে সক্ষম।
ক্লাউড সংযোগ – আমাদের ফোনে ডিফল্ট মেমোরি এর সাথে আমরা অনেক সময় অতিরিক্ত মেমোরি-কার্ড ব্যাবহার করি। যেকোন সফটওয়্যার বা অ্যাপ সেই মেমোরি তে তাদের প্রয়োজনীয় ফাইল সংরক্ষণ করে। কিন্তু একসময় আপনার ডিভাইস এর মেমোরি শেষ হয়ে যেতে পারে বা মেমোরি কার্ড এর কোন ক্ষতি হতে পারে। যার ফলে সফটওয়ার বা অ্যাপ এর গতি কমে যায়। 5G প্রযুক্তিতে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ক্লাউড-মেমোরি নির্ভর সফটওয়্যার সার্ভিস যোগ করার মাধ্যমে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার চোখের পলকে বর্ণ-ছবি-ভিডিও ভেসে উঠবে, কোন প্রকার লোডিং টাইম না নিয়ে।
ডিভাইস সংখ্যা – 4G নেটওয়ার্ক একটি সুনির্দিষ্ট এলাকা বা রেঞ্জের মধ্যে যত সংখ্যক ডিভাইসকে কানেকশন দিতে পারে, ঠিক একই পরিসরে; 5G নেটওয়ার্ক এর পক্ষে তার চাইতে দশ গুন বেশী ডিভাইস কে সংযোগ দিতে পারে। এর ফলে বাসাবাড়ি-অফিস বা অন্য কোথাও একই সাথে অনেকগুলো ডিভাইস ব্যাবহার করা সম্ভব হয়, এবং ইন্টারনেট স্পিড এর কোন হ্রাস হয় না।
কি কি পরিবর্তন আসতে চলেছে?
শিক্ষা ব্যবস্থা- অনলাইন ক্লাস এখন একটি সময়োপযোগী পড়াশোনা এবং শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার মাধ্যম। ডিজিটাল মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট-প্রেজেন্টেশন এর কাজে ছাত্রদের জন্য এখন একটি অত্যাবশ্যক চাহিদা হল দ্রুত গতির ইন্টারনেট। 5G টেকনোলজি এই ক্ষেত্রে বাধাহীন ক্লাস কার্যক্রম এবং ছাত্র ছাত্রী-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে সহজ উপায়।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা – সকল প্রতিষ্ঠান তাদের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এ তথ্য বা ডাটা আদান প্রদান করে। 5G প্রযুক্তির মাধ্যমে সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা আরও গতিশীলতার সাথে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। আরও বেশি আকারে তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
স্মার্ট হোম – আমরা আমাদের বাড়িতে কতরকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যাবহার করি। স্মার্ট হোম হল এমন ধরনের একটি বাড়ি যেখানে একটি কেন্দ্রীয় সিস্টেম বা কম্পিউটার অন্য সকল স্মার্ট ডিভাইসকে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ এবং সঞ্চালন করে। ধরুন আপনি ভুলে কোন রুমের লাইট অন করে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্মার্ট হোম স্বয়ংক্রিয় ভাবে সেই লাইট অফ করে দিতে পারবে। কিন্তু এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহার উচ্চ গতির ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া সম্ভব নয় এবং 5G-ই হল এখন পর্যন্ত এর সবচেয়ে আধুনিক সমাধান।
ড্রাইভারলেস কার – টেসলা এবং আরও কিছু গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাজারে ড্রাইভারবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ছাড়তে চলেছে। এই গাড়িগুলো বয়স্ক/প্রতিবন্ধি ব্যাক্তিদের যোগাযোগ ব্যাবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি আনতে যাচ্ছে । 5G নেটওয়ার্কিং টেকনোলজির মাধ্যমে এই গারিগুলো রাস্তায় থাকা অন্য গাড়িগুলো খুব সহজে শনাক্ত করতে পারে, অন্যান্য যানবাহনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এবং এর ফলে শতভাগ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
বাংলাদেশ এবং 5G-
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২১ সালের মধ্যে দেশে 5G ইন্টারনেট পরিষেবা সহজলভ্য করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। বিটিআরসি, মোবাইল অপারেটরদের এই শর্তে লাইসেন্স দেয় যে; তাদের ২০২৩ সালের মধ্যে সমস্ত জেলা সদর ৫-জি সার্ভিসের আওতায় আনতে হবে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে পুরো দেশকে। কোভিড -১৯ মহামারীর প্রভাব ফাইভ-জি প্রযুক্তির জন্য অপারেটরের প্রস্তুতি কমিয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি পঞ্চম প্রজন্মের (5 জি) সেলুলার নেটওয়ার্কগুলির জন্য টেলিকম নিয়ন্ত্রকের খসড়া গাইডলাইন সত্ত্বেও, মোবাইল অপারেটররা বলেছেন যে বড় পদক্ষেপ নেওয়ার আগে দেশের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ 4G সংযোগ দিয়ে প্রবেশ করা দরকার। দেশের নিবন্ধিত হ্যান্ডসেটগুলো ৩০ শতাংশেরও কম 4G সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই 5G এর জন্য এই মুহুর্তে আরও ব্যাপক আলোচনা করা দরকার বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। ডিজিটাল-কান্ট্রি হিসেবে বিশ্বে আমাদের দেশ পরিচিত। এই অগ্রযাত্রাকে আরো সুগম করতে, 5G প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের দেশে অত্যাবশ্যক । সরকার ইতিমধ্যে এই ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাময় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেগুলো কার্যকর করার পথে। এই সুবিধা যদি বাংলাদেশের প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রী, কর্মজীবী তথা সর্বসাধারণের জন্য সুলভ করা হয়, তাহলে আমাদের সামনে অনেক দুয়ার খুলে যাবে। আমাদের দেশে প্রায় সাত লক্ষ ফ্রিল্যান্সার আছে যারা অনলাইন-এ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। 5G প্রযুক্তি সুলভ মুল্যে উপলব্ধ করতে পারলে, আমাদের আরও অনেক তরুণ প্রজন্ম অনলাইন-এ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। শিক্ষা-চিকিৎসা এবং ব্যাংকিং সেক্টরে আমূল পরিবর্তন আসবে। সূচনা হবে স্মার্ট-বাংলাদেশ যুগের।