চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বটাই ডিজিটাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রযুক্তির দিক দিয়ে অর্থনৈতিক শিল্পেও দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের মাধ্যমে এখন পেমেন্ট করা সম্ভব হচ্ছে।
কোভিড-১৯ মহামারির ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারণে ডিজিটাল সেবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন ক্ষেত্রে রকেট গতিতে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটছে। ফিনটেক বা অর্থনৈতিক প্রযুক্তি খাতেও এই রূপান্তরের প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে ফিনটেক শিল্পে চলছে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। ফলে নতুন নতুন অনেক চ্যলেঞ্জও সামনে আসছে। অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক উদ্ভাবনগুলি কীভাবে বর্তমান আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থাকে আমূল বদলে ফেলতে পারে? আর এসব উদ্ভাবন নতুন কী কী চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে আসবে?
নতুন ধরনের তথ্য-
তথ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবন হলো গ্রাহকদের বিভিন্ন অনলাইন কার্যক্রমের ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থেকে আগত নতুন ধরনের ডেটার ব্যবহার বেড়ে যাওয়া। এসব তথ্য প্রধানত গ্রাহক ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন কি না, তা বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
আয়, কর্মসংস্থান, সম্পদ এবং ঋণের মতো তথাকথিত হার্ড ইনফরমেশন বা নিরেট তথ্য ব্যবহার করে ক্রেডিট স্কোরিং নতুন কিছু নয়। সাধারণত যত বেশি ডেটা পাওয়া যায়, মূল্যায়নও ততই সঠিক হয়। তবে এই পদ্ধতিতে দুটি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, নিরেট তথ্যগুলি সাধারণত “প্রোসাইক্লিকাল” হয়ে থাকে। তার মানে ভালো সময়ে এটি ঋণ সম্প্রসারণ বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু মন্দার সময়ে ঋণের বাজারে সংকট তৈরি হয়।
দ্বিতীয়ত সবচেয়ে জটিল সমস্যাটি হলো নতুন উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক এবং অনেক শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের মতো নির্দিষ্ট ধরনের লোকদের ব্যাপারে পর্যাপ্ত হার্ড ডেটা সহজলভ্য নাও হতে পারে।
ফিনটেক এই সমস্যার সমাধান করে এমন ডেটা সংগ্রহ করে, যা সরাসরি অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত না। যেমন, ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে কী ধরনের ব্রাউজার এবং হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে, অনলাইন সার্চের ইতিহাস এবং কেনাকাটার ইতিহাস ইত্যাদি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং দ্বারা চালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, তথ্যের এই বিকল্প উৎসগুলি প্রায়ই প্রচলিত ঋণ মূল্যায়ন পদ্ধতির তুলনায় বরং আরো বেশি ফলদায়ক। এবং এর মধ্য দিয়ে আরো বেশি মানুষকে আর্থিক সহায়তার আওতায় আনা যাবে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ অঞ্চলের শ্রমিক, অভাবী পরিবার এবং খামারগুলিকে ঋণের আওতায় আনা যাবে।
যোগাযোগের নতুন চ্যানেল-
সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল যোগাযোগ এবং অনলাইন শপিংয়ের মতো বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখন গ্রাহকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেন। এসব প্ল্যাটফর্ম বা সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ার ফলে আরো বেশি পরিমাণে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট তৈরি হচ্ছে এবং ডেটার প্রাপ্যতা বাড়ছে। এসব কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও উদ্ভাবনের গতি বাড়ছে। অ্যামাজন, ফেসবুক বা আলিবাবার মতো প্ল্যাটফর্মগুলি তাদের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে আরও বেশি বেশি অর্থনৈতিক পরিষেবা বা সার্ভিস যুক্ত করছে। ফলে নতুন নতুন অনেক ফিনটেক প্রতিষ্ঠান এবং প্রযুক্তি বাজারে আসছে।
অর্থনীতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলে ব্যাংকে শারীরিকভাবে হাজির হওয়ার পরিবর্তে অনলাইন লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে গ্রাহক সেবা আরো উন্নত হচ্ছে এবং আনুষঙ্গিক খরচও কমে আসছে। এতে করে ব্যাংকগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে, তেমন দূরবর্তী অঞ্চলে থাকা গ্রাহকও ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসতে পারছে।
অর্থনীতিতে ডিজিটাল রূপান্তরের প্রভাব অনেক শক্তিশালী। ইতিমধ্যেই এই শিল্প কম্পিউটারের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ১৫টি বৃহত্তম অর্থনীতিতে গত দুই দশকে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার দ্বিগুণ হওয়ার ফলে এই নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।
নীতিগত চ্যালেঞ্জ-
অর্থনীতিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলে তথ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল উদ্ভাবন আরও গভীর থেকে গভীরতর হতে বাধ্য। ফলে বিদ্যমান বেশ কিছু নীতিগত ক্ষেত্রে নতুন অগ্রাধিকারের জন্ম হবে। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আর্থিক খাতে রেগুলেটরদেরকে নতুন আসা প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক মডেলগুলির ঝুঁকির মূল্যায়ন করতে হবে।
অন্যান্য ঝুঁকিগুলিও বড় আকার ধারণ করবে। যেমন, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়বে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকরা বেশি বেশি অনলাইন পরিষেবা ব্যবহার করার ফলে অপরাধীদের জন্যও সম্ভাব্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আর্থিক নীতিমালার পরিবেশও বদলে যাবে। নতুন আর্থিক নীতিমালা এবং অর্থ লেনদেনের চ্যানেলগুলিও পুরোপুরি বুঝতে হবে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক নীতি এবং বড় বড় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের একচেটিয়া রাজত্ব কায়েমের প্রবণতা মোকাবিলা করা। এতে নেটওয়ার্কের প্রভাব যেমন বাড়বে, তেমন কয়েকটি বৃহৎ প্ল্যাটফর্মের হাতে সব নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার ঝুঁকিও কমবে। এজন্যে ভোক্তার গোপনীয়তার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষতা এবং নিরাপত্তার সাথে তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং ডেটা বিনিময় নিশ্চিত করতে ডেটা নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।
আর্থিক খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের গতি সময়ের সাথে সাথে দ্রুততর হচ্ছে। ফিনটেকের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী আরো ১০০ কোটি মানুষ আর্থিক সেবার আওতায় আসতে পারে। আর্থিক খাতে যে প্রযুক্তিগত রূপান্তর শুরু হয়েছে, বিভিন্ন দেশের সরকারের তাতে প্রণোদনা নিশ্চিত করা উচিত। সেই অনুসারে বিভিন্ন নীতি সমন্বয় করাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।