পেপালের বিস্তারিত ইতিহাস-
ইংরেজি ভাষায় ‘পাল’/Pal শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। এটি দ্বারা বিশেষ বন্ধু বা দোস্ত কে সম্বোধন করা হয়। আজকের লেখাটি এমনই এক বিশেষ বন্ধুকে নিয়ে, যেটি অর্থ লেনদেন এর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে গত শতাব্দীর শেষভাগে।
১৯৯৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে গ্রাহক সংখ্যা এবং উপার্জন উভয় ক্ষেত্রে পেপাল ইতিহাসের প্রায় অন্য যে কোন সংস্থার চেয়ে দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করেছে। পেপালের পরিষেবাতে প্রতিদিন ১-লক্ষেরও বেশি লোক সাইন আপ করে। প্রতি সেকেন্ডে গড়ে পেপাল ফাইনান্সিয়াল ইঞ্জিনের মাধ্যমে $1000- এক হাজার ডলার এর বেশি টাকা আদান-প্রদান হয়। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীরা অনলাইনে পেমেন্টের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পেপালকে বেছে নিয়েছে । পেপাল এখন একশটিরও বেশি দেশে এবং ১৭ টি মুদ্রায় সেবা প্রদান করছে। তবে এই কোম্পানির ব্যাবসায়িক সফলতা একদিনে আসেনি। যদি বলি- চালু করার প্রথম বছরেই পেপালের ব্যবসা আমেরিকাতে মুখ থুব্ড়ে পড়েছিল; তাহলে কি কেউ বিশ্বাস করবে? কিন্তু ঘটনা কিছুটা এরকম। চলুন আজ জেনে নেয়া যাক- বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অনলাইন মানি ট্রান্সফার -এর এই কোম্পানির গড়ে ওঠার ইতিহাস এবং বাংলাদেশে কবে নাগাদ এই সেবা আসতে পারে সে বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
কিভাবে গড়ে ওঠে পেপাল?
- পিটার থিয়েল নামক একজন ব্যক্তি ১৯৮৭ সালে, “স্ট্যানফোর্ড-রিভিউ” নামে একটি স্টুডেন্ট-পাবলিকেশন প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি ইন্টারনেট এর মাধ্যমে অর্থ লেনদেন নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
- ১৯৯৮ সালে এই পাবলিকেশন্স এর সাথে সংযুক্ত কয়েকজন- ম্যাক্স লেভচিন, পিটার থিয়েল এবং লুক নসেক মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কনফিনিটি’ নামক একটি কোম্পানি। এই কোম্পানি বিভিন্ন ব্যাংক এবং বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক লেনদেনের জন্য গুপ্তসংকেত (IR-Code) তৈরি করার কাজ করে।
- ১৯৯৯ সালে আমাদের সকলের পরিচিত এলন মাস্ক প্রতিষ্ঠা করেন এক্স.কম (x.com)। এই ওয়েবসাইট শেয়ার-বাজার, ক্রেডিট লেনদেন, বিনিয়োগ মাধ্যমে সেবা প্রদান করত।
- ২০০০ সালে কনফিনিটি এবং এক্স.কম একত্রিত হয়। দুই প্রতিষ্ঠান মিলিতভাবে তৈরি হয় একক একটি কোম্পানি। যার নাম দেয়া হয়- পেপাল! যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অধিকাংশ নিলামকারী সংস্থা; ই-কমার্স ওয়েবসাইট এ ব্যাপকভাবে ব্যাবহার শুরু হয় পেপালের। প্রতিদিন প্রায় দুই লক্ষেরও বেশি আর্থিক আদান প্রদান রেকর্ড হতে শুরু করে পেপালের মাধ্যমে।
- ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে সেসময়ের জনপ্রিয় এ-কমার্স ই-বেই (eBay) ১৫০ কোটি ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় পেপাল। এর পেছনে কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়- ই-বের অর্ধেকের বেশি ব্যবহারকারী পেপ্যালের মাধ্যমেই কেনাকাটা করা আর পেপালের সল্প সময়ের মধ্যেই অর্জিত সাফল্য।
- ২০০৬ সালে পেপাল দশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তাদের সেবার অন্তর্ভুক্ত করে যার মধ্যে সিঙ্গাপুর-ডলার এবং সুয়িস-ফ্র্যাঙ্ক ও ছিল।
- ২০০৭ সালে পেপাল ইউরোপের বাজারে সেবা দেয়ার লাইসেন্স পেয়ে যায়। এর মাধ্যমে এটা পশ্চিমা ই-কমার্স সেক্টরে একক রাজত্ব গড়ে তোলে। পরবর্তী বছরগুলোতে পেপাল এর ব্যবসা আরও প্রসার ঘটতে থাকে। অন্তর্ভুক্ত হয় আরও অনেক দেশ- আরও অনেক মুদ্রা।
- ২০১৫ সালে পেপাল “ই-বে” এর সাথে ব্যাবসায়িক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। এর পেছনে eBay কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রসার শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকাকে কারণ হিসেবে দাবি করা হয়।
- অন্যদিকে পেপাল ধীরে ধীরে আরও অনেক প্রতিযোগী বা সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান কিনতে শুরু করে। ২০১৮ সালে সুইডেন-এ অবস্থিত এমন একটি কোম্পানি “iZettle’ – কে পেপাল ২.২ বিলিয়ন ডলার এর বিনিময়ে কিনে নেয়।
বর্তমানে পেপাল!
বর্তমানে, পেপাল (PayPal) সর্বমোট ১৯০ টি দেশে এর কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২৩ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে এর । পেপ্যাল ২৪ টি মুদ্রায় গ্রাহকদের অর্থ প্রেরণ-গ্রহণ ও সংরক্ষণ করার সুযোগ দিয়ে থাকে। পেপ্যালের প্রাতিষ্ঠানিক সদর দফতর সান জোসে- যুক্তরাষ্ট্রতে। তবে তাদের মূল কর্মকেন্দ্র নেব্রাস্কা ওমাহায় অবস্থিত, যেখানে প্রায় ৩০০০ কর্মচারী কর্মরত আছেন। পেপ্যালের ইউরোপীয় সদর দপ্তর লুক্সেমবার্গ এবং সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর আছে। PayPal-Labs.com নামে পেপালের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এটি বেশকিছু নতুন প্রযুক্তি, পদ্ধতি, ও সেবার প্রদর্শনী জন্য কাজ করে।
কিছু দেশে পেপাল বিধিনিষেধ মেনে ব্যবসা করে। যেমন চীনে পেপাল দুইটি ওয়েবসাইট দিয়ে তাদের ব্যাবসা পরিচালনা করে। তাদের বেসিক পেপ্যাল ডট কম এবং শুধুমাত্র চীনের অভ্যন্তরীণ লেনদেন এর জন্য নির্মিত পেপ্যাল ডট সিএন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পেপাল তাদের সমঝোতা চুক্তি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় ২০১১ সালে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এর নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য।
বাংলাদেশে কবে আসবে পেপাল?
বাংলাদেশে বর্তমানে ই- কমার্স এবং গ্লোবাল ট্রেড এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছে । অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ-এশিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ। এছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় সাত লক্ষের বেশি মুক্ত-পেশাজিবী বা ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। এসকল ফ্রিল্যান্সারদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এ নির্দিষ্ট ফি প্রদান করার মাধ্যমে বিদেশী ক্লায়েন্ট বা বায়ারের সাথে কাজ করতে হয়। যেখানে এই ইন্ডাস্ট্রিতে বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট পেপাল এর মাধ্যমেও পেমেন্ট করতে আগ্রহী থাকেন, কিন্তু আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা এখনও সেই সুযোগ গ্রহন করতে পারেন না। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে পন্য আমদানি করতে গিয়ে পেমেন্ট জটিলতার কারণে পিছিয়ে পড়েন। পেপাল থাকলে এই সমস্যা খুব সহজেই সমাধান হতে পারে। আমাদের অনেক ইঞ্জিনিয়ারদের তাদের প্রজেক্ট এর জন্য পার্টস-যন্ত্রপাতি কিনতে হয়। অনেক সময় সেটি বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় না। তখন তারা বিদেশের কিছু ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে সেটি তাদের প্রয়োজনমত তৈরি করিয়ে, বাংলাদেশে আনেন। এক্ষেত্রে পেমেন্ট-অর্ডার- ডেলিভারীতেই অনেক অতিরিক্ত সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়। পেপাল থাকলে সেটা হত না।
এসকল কারণে বাংলাদেশে পেপাল চালু হওয়া একটি সময়ের দাবি। ২০১৭ সালে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বরাত দিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করে যে, সেই বছরেই বাংলাদেশ এ পেপাল চলে আসবে। তবে বেশ কিছু জটিলতার কারণে সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। “জুম” নামে বাংলাদেশ সরকার পেপাল অনুমোদিত একটি সেবা চালু করে পরবর্তীতে।
তবে আশার কথা হল- ২০২১ এর জুন মাসে বাংলাদেশে আমাজন ডট কম এবং গুগল ইনকর্পোরেটেড ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন করে। এর মাধ্যমে ই- কমার্স জগতের সবচেয়ে বড় দুই জায়ান্ট বাংলাদেশে তাদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, এর মাধ্যমে আরো গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে আসার পথ সুগম হয়েছে।