নাসার অধীনে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির আইডিয়া নিয়ে কাজ করে ‘নাসা ইনোভেটিভ অ্যাডভ্যান্সড কনসেপ্টস প্রোগ্রাম’। সংক্ষেপে এই প্রোগ্রামকে NIAC বলা হয়। এ পর্যন্ত NIAC এর সুদূরপ্রসারী প্রোগ্রাম থেকে এক ডজনেরও বেশি গবেষক অনুদান পেয়েছেন।
এসব অনুদান দিয়ে তারা নিজেদের আইডিয়া নিয়ে আরো বিস্তর পরিসরে গবেষণা করতে পারবেন। এই আইডিয়াগুলি এমন সব প্রযুক্তির ধারণা দেয়, যা সায়েন্স ফিকশনকেও হার মানায়। মনে হয় যেন বাস্তব আর কল্পনার মাঝামাঝি কোনো জায়গা থেকে এসব প্রযুক্তি উঠে এসেছে।
১. বহনযোগ্য ম্যাগনেটিক হাইওয়ে-
চাঁদে বহনযোগ্য ম্যাগনেটিক হাইওয়ে ব্যবহার করে কীভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছেন নাসার জেট প্রপালশান ল্যাবের একজন রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ার।
যখন মানুষের দীর্ঘ সময়ের জন্য চাঁদে বসতি হবে, সেখানে নিয়মিত মালামাল পরিবহনের প্রয়োজন হবে। বাতাস, পানি বা জ্বালানি, যেকোনো প্রয়োজনেই জন্যই চাঁদের মাটি খোঁড়া হবে। ফলে খনন করা মাটি পরিবহনের প্রয়োজন পড়বে। এই কাজের জন্য প্রাথমিক আইডিয়া হলো একটা সমতল রাস্তা বিছানো। এই রাস্তা রোল করা বা প্যাঁচানো অবস্থায় থাকবে এবং এর সাহায্যে চাঁদের পৃষ্ঠে স্থায়ী অবকাঠামো ছাড়াই রাস্তা তৈরি করা যাবে।
স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সপোর্ট রোবট দিয়ে এই ম্যাগনেটিক হাইওয়ের চৌম্বক ক্ষেত্র কাজে লাগিয়ে একে বাতাসে লেভিয়েট করা বা ভাসানো হবে। তখন এই রোবটগুলি হাইওয়ে বহন করে নিয়ে যাবে। এটা সম্ভব হবে, কারণ চাঁদে বাতাস নেই আর মাধ্যাকর্ষণও অনেক কম। ফলে বাতাসের ঘর্ষণ ছাড়াই চাঁদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ম্যাগনেটিক হাইওয়ে বহন করা যাবে।
২. সুইমবট-
জেট প্রপালশান ল্যাবের সেই একই গবেষক আরো একটি রোবট নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন, যেটি সাঁতার কাটতে পারে। এই সুইমবট জুপিটার এর চাঁদ ইউরোপা বা শনির চাঁদ টাইটান যেখানে মিথেন আছে, সেখানে অনায়াসে অভিযানে যেতে পারবে।
মহাকাশে মানুষের বিচরণ যত বাড়বে, ততই এমন বিপদসংকুল ও দুর্গম জলীয় পরিবেশের মুখোমুখি হতে হবে। বিভিন্ন গ্রহে অভিযান পরিচালনায় বর্তমানে মাটিতে চলতে পারে বা আকাশে উড়তে পারে, এমন যান ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, এসব গ্রহ বা উপগ্রহে নিরেট ভূপৃষ্ঠ রয়েছে। তবে বৃহস্পতি বা শনির মতো গ্রহগুলির উপগ্রহে অভিযান চালাতে হলে সুইমবটের মত নতুন ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়বে।
৩. মহাকাশের মাটি তৈরি করা-
ট্রান্স অ্যাস্ট্রোনোটিকা কর্পোরেশনের গবেষকরা অ্যাস্টোরয়েড বা গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে উর্বর মাটি তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন। এজন্য তারা পৃথিবী থেকে ফাঙ্গাস নিয়ে সেটা দিয়ে প্রথমে মাটি উর্বর করবেন। তারপর সেই মাটি ব্যবহার করা হবে মহাকাশে গাছপালা ও ফসল ফলানোর জন্য।
এর আগে দামি ধাতু মাইনিং করার জন্য অ্যাস্টোরয়েড খনন করার আইডিয়া অনেক দিন ধরেই গবেষকরা ভেবেছেন। এজন্য তারা গ্রহাণুকে পৃথিবী বা চাঁদের কক্ষপথে নিয়ে আসা বা সরাসরি গ্রহাণুতে গিয়ে খনন করার পরিকল্পনা করতেন। কিন্ত গ্রহাণু থেকে ফসলি মাটি সৃষ্টির এই আইডিয়া আসলেই অভিনব।
আমাদের সৌরজগতে যেমন ভেসে থাকা গ্রহাণুর অভাব নেই, ফসল ফলানোর মত উর্বর মাটি পাওয়ার সম্ভাবনাও তেমনি অনেক। হয়তো এই মাটি থেকে ফসল ফলিয়ে কোনো এক সময় বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে
৪. রেডিমেড স্পেস হোম-
নাসার তত্ত্বাবধানে কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক কম ওজনের কোলাপসিবল যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছেন। এসব যন্ত্রপাতি খুব সহজেই স্থানান্তর করা সম্ভব। ফলে মহাশূন্যে স্থাপনা নির্মাণ করার জন্য এগুলি ‘বিল্ডিং ব্লক’ হিসেবে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এসব ব্লক ব্যবহার করে বড় বড় স্থাপনা বা মহাশূন্যে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ স্ট্রাকচার তৈরি করা যাবে।
সায়েন্স ফিকশন লেখকরা যেভাবে মহাশূন্যে বসতি নির্মাণের কথা ভাবতেন, স্পেস হোমের এই বিষয়টা অনেকটাই তেমন। এটা হবে এমন ধরনের স্থাপনা, যেখানে বড় বড় বসতি থাকবে। এবং একই সঙ্গে জীবনধারণের জন্য স্থাপনাগুলির নিজস্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম থাকবে।
৫. সুপারচার্জড সৌর শক্তি-
নাসার ল্যাংলি গবেষণা কেন্দ্রের একজন গবেষক কাজ করছেন অতি শক্তিশালী সৌর শক্তি নিয়ে। টেলিস্কোপের অপটিকসের ব্যবহার করে সূর্যের শক্তিকে ধারণ করা, দিক পরিবর্তন করা এবং ফোকাস করা হচ্ছে এই আইডিয়ার মূল অংশ।
যদিও সৌর শক্তির ব্যবহার নতুন কিছু না, কিন্ত চাঁদের মাটিতে এই শক্তি কাজে লাগানো বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। এজন্য এমন ডিজাইনের সিস্টেম তৈরি করতে হবে যেটা ছোট এবং হালকা। যা সহজেই পৃথিবী থেকে চাঁদে বহন করা যায়। একই সাথে সূর্যের আলো থেকে যথাসম্ভব শক্তি ধারণ করার মত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
সায়েন্স ফিকশন আমাদের নতুন উদ্ভাবন, নতুন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। আবার এটাও সত্যি যে, মহাকাশ অভিযানের লক্ষ্যে করা অনেক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তি আমাদের কল্পনাকে প্রসারিত করে। একইসঙ্গে আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাও অনেক বিকশিত করে।
মানুষ যতই পৃথিবী থেকে মহাকাশে বসতি স্থাপন করার কথা ভাবছে, ততই এমন ধরনের দুঃসাহসী চিন্তাভাবনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।