ড্রোন-প্রযুক্তি!
আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি, তারা কখনও আকাশে ঘুড়ী উড়তে দেখিনি; সেটা সম্ভব নয়। বাহারি রঙের কাগজ আর নাটাই-সূতা নিয়ে আমরা অনেকেই বাসার ছাদে বা খোলা মাঠে উড়িয়েছি ঘুড়ি। সুতা আর নাটাই এর টান এর উপর ভর করেই, ঘুড়ী বাতাসে ভেসে থাকে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষ আজ সেই ঘুড়ির জাইগায় এনেছে পাখা লাগানো একটি মেশিন আর নাটাই এর জায়গা নিয়েছে একটি রিমোট-কন্ট্রোল! সুনির্দিষ্ট কাজের উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা একটি পাখা লাগানো যন্ত্রকে; দূরবর্তী একটি রিমোট কন্ট্রোল এর দ্বারা আকাশে উড্ডয়ন এবং অবনমন করানোর প্রকৌশলকে – ড্রোন প্রযুক্তি বলা হয়। এই প্রযুক্তি নিয়ে প্রথমদিকে সামরিক উদ্দেশ্যে গবেষণা করা হলেও, পরবর্তীতে আরও অসংখ্য ক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু হয়। আজকে আমরা এই ড্রোন প্রযুক্তির আদ্যপ্রান্ত- বর্তমান ব্যাবহার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ড্রোন-প্রযুক্তির ইতিহাস-
“ড্রোন” শব্দটি সাধারণ ভাষায় কোন পাইলটবিহীন বিমানকে বোঝায়। কখনও কখনও একে “Unmanned Aerial Vehicles” (UAV) হিসাবেও সম্বোধন করা হয়। সামরিক কাজ থেকে শুরু করে প্যাকেজ বিতরণ অবধি, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ড্রোন এর ব্যবহার দিন দিন আরও বিস্তার লাভ করছে। মূলত সামরিক এবং মহাকাশ শিল্পের জন্য ডিজাইন শুরু হলেও, ড্রোন মাধ্যমে সুরক্ষা এবং দক্ষতার বর্ধিত স্তরের কারণে; এটি মূলধারায় প্রবেশ করেছে।
প্রথম পাইলটবিহীন বিমান প্রথম-বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিকশিত হয়েছিল। ব্রিটেনের “এরিয়াল টার্গেট”- একটি ছোট রেডিও-নিয়ন্ত্রিত বিমান, ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল। আমেরিকার তৈরি টর্পেডো প্রথম ১৯১৮ সালের অক্টোবরে উড়েছিল। যদিও উভয় ফ্লাইট পরীক্ষা ভাল কার্যক্ষমতা ও সম্ভাবনা দেখিয়েছিল, কিন্তু কোনটিই যুদ্ধের সময় কার্যকর ভাবে ব্যবহৃত হয়নি।
সর্বপ্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধে বৃহৎ আকারে ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে। যুদ্ধে ডিকয়ের চরিত্রে অভিনয় করা, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা এবং মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের জন্য লিফলেট ফেলে দেওয়ার মতো নতুন ভূমিকাতেও ড্রোন ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের অন্যান্য দেশগুলো মানুষহীন বিমান প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করে। উন্নত সহনশীলতা এবং আরও বেশি উচ্চতা বজায় রাখার ক্ষমতা সহ নতুন মডেলগুলি আরও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের একটি যৌথ প্রকল্প আরকিউ-2-পাইওনিয়ার নামে- মাঝারি আকারের এবং স্বল্প-ওজনের ড্রোন বানাতে সক্ষম হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ড্রোন এর এমন মডেল তৈরি করা হয়েছে যা দীর্ঘ ফ্লাইট জ্বালানির সমস্যা মোকাবেলায় সৌর বিদ্যুতের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
বর্তমানে ড্রোনের ব্যবহার-
◾ ২০০১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশ ড্রোন ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এবং ভূখণ্ডগুলিতে নজরদারি করার জন্য ব্যবহৃত হয় যেখানে সৈন্যদের নিরাপদে যাওয়া প্রয়োজন। তবে এগুলি অস্ত্র হিসাবেও ব্যবহৃত হয় এবং সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় মিসাইল হামলা করতে পারে নিখুঁতভাবে।
◾ ড্রোনের সাথে সংযুক্ত ক্যামেরার মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট এলাকার চিত্র ধারণ করা যায়। বর্তমানে এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে কৃষকরা তাদের বিশাল জমিতে ফসলের বৃদ্ধি ও রোগবালাই সনাক্ত করতে পারেন। বড় খামারি রা তাদের খামারে এটি ব্যাবহার করেন। সার-কীটনাশক ছিটানোর জন্য বিশেষ ধরনের ড্রোন বানানো হচ্ছে এখন।
◾ চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ড্রোনের ব্যাবহার শুরু হয়েছে। জরুরী ওষুধ-ইঞ্জেকশন এবং টিকা ড্রোনের মাধ্যমে ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে খুব সহজে।
◾ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে এখন ড্রোনের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। বাণিজ্যিক কারখানা, পাহাড়ী রাস্তাঘাট, ব্রিজ এবং বাঁধ এগুলো তৈরি করার পূর্বে ড্রোন উড়িয়ে সম্পূর্ণ প্লট এর ম্যাপিং খুব সহজে করা যায়।
◾ নাটক-সিনেমা এবং মিউজিক ভিডিওতেও এখন ড্রোনের মাধ্যমে চিত্র ধারণ করা হয়। ফটোগ্রাফাররা UAV-গুলি বিস্তৃত এরিয়াল ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করে। আপনার প্রিয় শহর, সৈকত বা বিল্ডিং পাখির চোখের দৃষ্টিতে কেমন তা ফটোগ্রাফির জন্য বিশেষভাবে তৈরি ড্রোন রয়েছে যা উপরে থেকে আপনার প্রিয় এলাকা ফটোগ্রাফ করার নতুন উপায় সরবরাহ করে।
◾ করোনা ভাইরাস মহামারীর সময়ে কোয়ারানটাইন এবং সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন করতে; এবং চিকিৎসা সহায়তা সরবরাহ করতে, ড্রোন এর ভূমিকা অনস্বীকার্য
ড্রোনের ভবিষ্যৎ!
গ্রামীণ প্রান্তিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণে এই আধুনিক প্রযুক্তির সম্ভাবনা অনেক। পৃথিবীর অনেক দেশ এখনও সকল নাগরিকের জন্য খাদ্য – চিকিৎসা – শিক্ষা এর মত মৌলিক সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। আফ্রিকার অনেক দেশে জাতিসংঘ ত্রান সুবিধা দিচ্ছে এখনও। এসব ত্রাণ যেন প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে সেটি ড্রোন ব্যাবহার করে নিশ্চিত করা হয়।
ড্রোন হল বন্যজীবন সংরক্ষণের একটি সহজ এবং কার্যকর বিকল্প। পৃথিবীতে মানুষের সাথে বন্য জীবনের বিকাশ ও সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকাশে এক নজর রাখার মাধ্যমে বন্য প্রজাতি এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা পেতে সক্ষম হবে। সংরক্ষণ ড্রোনগুলো দিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার শিকারের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহন করা যাবে।
ড্রোন প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং করোনা মহামারী এর প্রয়োজনীয়তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও অনেকে মনে করেন যে এটি এখনও জনসাধারণের সার্বিক ব্যাবহার থেকে দূরে রয়েছে; তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন; প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এই প্রযুক্তিকে আরও কর্মক্ষম করে তুলতে। বর্তমানে যদিও এটি সফলভাবে সরকারী এবং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন বৃষ্টি-বজ্রপাত এর বিপক্ষে এর তেমন কোন প্রতিরক্ষা নেই। যান্ত্রিক ত্রুটি ঠিক করার জন্য এর মেকানিক পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। তবে এসব সমস্যা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা ঘরের জানালা দিয়ে ড্রোন প্রবেশ করতে দেব সাচ্ছন্দে। দৈনন্দিন জীবনে ড্রোন হবে আমাদের বিশ্বস্ত উড়ন্ত সহচর।