ব্যবসার নতুন নতুন মডেলের উত্থান এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ধারাবাহিক বিকাশের পাশাপাশি এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বাণিজ্যও ক্রমশ জটিল এবং গতিশীল হয়ে উঠছে। মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন চুক্তি, রাজনৈতিক পরিবর্তন, ই-মার্কেটপ্লেসের বিস্তার এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে সাপ্লাই চেইনে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেও খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে।
মূল্য বিনিময়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসায় তাৎক্ষণিক ভাবে বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের পদ্ধতিতেও প্রভাব পড়ছে। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ভবিষ্যতে ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে কেবলমাত্র একটি সহজ এবং বিশ্বস্ত উপায়েই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে লেনদেনে সক্ষম করে তুলতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৈরি হওয়া নতুন নতুন প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্যে পেমেন্ট পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়টি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত হতে হলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিরাপত্তা, পরিচয় যাচাই এবং লেনদেন নিশ্চিত করতে তাদের পেমেন্ট পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
নানাবিধ প্রয়োজনীয়তার মধ্যে সমন্বয় সাধন-
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেমেন্ট পদ্ধতি বেশ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন দেশের মধ্যে পেমেন্ট পরিচালনা করতে একাধিক আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই স্থানীয় বিধিবিধান মেনে চলতে হয়।
যেমন, থাইল্যান্ডে কোনো পেমেন্ট পাঠাতে গেলে পেমেন্ট ইন্সট্রাকশনে অবশ্যই একটি ট্যাক্স আইডি অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, আর ভারতের বেলায় কী জন্য অর্থ প্রদান করা হচ্ছে, তার বিস্তারিত বিবরণ যুক্ত করতে হয়।
এই শর্তগুলি পূরণ না করলে লেনদেন বিলম্বিত হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেমেন্ট ডেলিভারিতে বর্তমানে যেসব বাধাবিপত্তি রয়েছে, সেগুলি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পেমেন্ট সিস্টেম সরল করার মাধ্যমে পারস্পরিক ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে বিভিন্ন দেশের সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ইউরোপে আঞ্চলিক পেমেন্ট সিস্টেমকে এমন একটি একক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং একক মুদ্রার অধীনে নিয়ে আসার একটি সফল উদাহরণ হল সিঙ্গেল ইউরো পেমেন্টস এরিয়া, যাকে সংক্ষেপে “SEPA” বলা হয়।
এশিয়ায় এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে সম্প্রতি রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (RCEP)-এর মতো আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো স্থানীয় পর্যায়ে এই অঞ্চলজুড়ে সাপ্লাই চেইনে সমন্বয় আনা। এমনই আরেকটি চুক্তি হলো কমপ্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (CPTPP)।
গ্লোবাল জিডিপির প্রায় ৩০% এবং বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ আরসিইপি চুক্তির অধীনে আসে। অর্থাৎ এই চুক্তিটি ইইউ, ইউএস-মেক্সিকো-কানাডা এবং সিপিটিপি-র বাণিজ্য চুক্তির চেয়ে বড়।
আন্তঃএশিয়া বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি যেভাবে হচ্ছে, তাতে এ ধরনের চুক্তির প্রয়োজন ছিল। কারণ সময়ের সাথে সাথে সাপ্লাই চেইন প্রতিনিয়তই বদলে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক শিল্পও এর একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। এই শিল্পের সাপ্লাই চেইন চীন থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলিতে ছড়িয়ে আছে। এই চেইনের মাধ্যমেই বিভিন্ন চাহিদা মেটাতে পণ্য আমদানি ও রফতানি করা হয়। এর ফলে যেমন বিভিন্ন দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্বব্যাপী লেনদেন করতে পারছে। আর বিশ্বব্যাপী একটি সিস্টেমের পারস্পরিক ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে বেসরকারি খাতই মূলত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
পেমেন্ট সিকিউরিটি মজবুত করতে মানদণ্ড ব্যবহার-
অর্থ স্থানান্তরের নানা উপায় তৈরি হওয়ার সাথে সাথে মানদণ্ড এবং সিস্টেমের পারস্পরিক ব্যবহারের সুযোগ, অংশগ্রহণ, নিরাপত্তার মতো অর্থ স্থানান্তরের বিভিন্ন বিষয়ই জরুরি হয়ে উঠবে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক স্ট্যান্ডার্ডগুলির মাধ্যমে এমন একটি সিস্টেম তৈরি হবে, যাতে পুরো নেটওয়ার্ক জুড়েই একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অর্থ লেনদেন করা যাবে।
আন্তঃব্যবহারযোগ্য ডিজিটাল আইডেন্টিটির মাধ্যমে সুরক্ষা-
স্থানীয় বিধিবিধানের জন্যে পেমেন্টে জড়িত লেনদেনকারী পক্ষগুলির পরিচিতি এবং পেমেন্টের উদ্দেশ্যের মতো কিছু তথ্যের প্রয়োজন হয়। এসব KYC (Know Your Customer) নীতির অন্তর্ভুক্ত। KYC এর স্ট্যান্ডার্ড বিশ্বব্যাপী নানান রকমের হয়ে থাকে। তবে বেনামে কোনো লেনদেন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এ বিষয়ে সকলেই একমত।
উন্নত অনেক দেশ এখন নানান ধরনের পেমেন্ট একটি জাতীয় ডিজিটাল অবকাঠামোর সাথে সংযুক্ত করার ফলে অর্থনৈতিক অনেক সুবিধা পাচ্ছে। তবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অ্যাকাউন্ট-টু-অ্যাকাউন্ট পেমেন্টের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এর জন্যে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি।
বিশ্বব্যাপী ব্যবহার্য বিভিন্ন সিস্টেমে এখনও জটিলতা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে অটোমেশন নিশ্চিত করলে এসব জটিলতা এড়ানো সম্ভব। ডিজিটাল আইডেন্টিটির ফলে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই পরিচয় যাচাই করা যায়। ফলে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও তাদের লেনদেনের বিবরণ এবং রিপোর্টে আস্থা রাখতে পারবেন। এতে দক্ষতা এবং নিরাপত্তার সঙ্গে পেমেন্ট প্রসেস করা সম্ভব হবে।
মূল্য বিনিময়ের নতুন ধরন-
সাপ্লাই চেইন স্থানান্তরিত হওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক পেমেন্টের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী সমাধান তৈরি হবে। তবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের বর্তমান অবস্থা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী ব্যবহারযোগ্য একটি পেমেন্ট সিস্টেম স্থাপন করাটা বেশ জটিল কাজ।
তবে নতুন নতুন প্রযুক্তি আবির্ভাবের সাথে সাথে উদ্ভাবনও ত্বরান্বিত হবে। বিভিন্ন শিল্পে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের মডেল বিকশিত করতে হবে। একই সঙ্গে লেনদেন প্রসেস করা, ক্লিয়ারিং এবং সেটেলমেন্টের মাধ্যমে ডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সুরক্ষা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার মতো সার্ভিসগুলিতেও যুক্ত হতে হবে।
নতুন ধরনের ভ্যালু সেটেলমেন্ট মডেলের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের গ্রাহকদের যা প্রয়োজন তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সক্ষমতা বিকাশ করতে হবে।
মহামারী শেষে বিশ্ব অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক হলে সম্ভাবনাময় অনেক সুযোগ তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসা করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিও এখন তাদের সাপ্লাই চেইনের সাথে খাপ খাইয়ে এবং ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা অনুকূল করে গড়ে তুলছে।