ডিজনির গল্প-
“All Our Dreams Can Come True, if We Have the Courage to Pursue Them.”
আপনি যদি কার্টুন দেখতে ভালোবাসেন, অথচ মিকি-মাউসের নাম শোনেননি সেটি সম্ভব নয়। এই মিকি-মাউস কার্টুন যার কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ নেয়- তার নাম “ওয়াল্ট ডিজনি”। একজন নামকরা কার্টুনিস্ট হওয়ার পাশাপাশি, তিনি ছিলেন একাধারে- সফল চিত্রপরিচালক, কণ্ঠশিল্পী এবং এনিমেশন মুভির প্রযোজক। যদি বলি, অত্যন্ত সফল এবং জনপ্রিয় এই ব্যক্তিটিই একসময়ে দেওলিয়া হয়ে ঋণ এর দায়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন- তাহলে সেটি কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে? কিন্তু বাস্তবে এরকম ঘটনাই ঘটেছে তুখোড় কল্পনাশক্তির অধিকারী এই মানুষটির সাথে। চলুন আজ জেনে নেয়া যাক ওয়াল্ট ডিজনির জীবনের সেই পতন আর বিস্ময়কর উত্থানের গল্প।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা
“ওয়াল্টার ইলিয়াস ডিজনি” ইলিনয়ের শিকাগো শহরে, 1901 সালের 5 ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবা ছিলেন আইরিশ-কানাডিয়ান ইলিয়াস ডিজনি এবং মা ফ্লোরা কল ডিজনি ছিলেন জার্মান-আমেরিকান। তাদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন ডিজনি। তিনি বেশিরভাগ শৈশব কেটেছে মিসৌরিতে, যেখানে তিনি প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের ছবি আঁকতে এবং বিক্রি শুরু করেছিলেন। 1911 সালে, তার পরিবার কানসাস সিটিতে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে ট্রেন-গাড়ির প্রতি ডিজনির ভালবাসার জন্ম নেয়। তার চাচা, মাইক মার্টিন ছিলেন একজন ট্রেন ইঞ্জিনিয়ার। ডিজনি ছোটবেলায় তার গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ট্রেনের যাত্রীদের কাছে স্ন্যাকস এবং সংবাদপত্র বিক্রি করত।
ডিজনি শিকাগোর ম্যাককিনলে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। এখানে মূলত বিকাশ ঘটে তার অঙ্কন প্রতিভার। স্কুলের অঙ্কন এবং ফটোগ্রাফি ক্লাস তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা শিল্পীকে সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়। স্কুল ম্যাগাজিনে তিনি কার্টুনিস্ট ছিলেন, এবং তিনি শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে কোর্স করেছেন। ডিজনির যখন 16 বছর বয়স, তখন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে স্কুল ছেড়ে যান। কিন্তু অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে তার আবেদন বাতিল হয়ে যায়। পরে, তিনি রেড ক্রসে যোগ দিয়েছিলেন এবং অ্যাম্বুলেন্স চালানোর জন্য এক বছরের জন্য ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল।
স্বপ্নের শুরু-
১৯১৯ সালে ডিজনি ফ্রান্স থেকে ক্যানসাস সিটিতে ফিরে আসেন সংবাদপত্রের চিত্রশিল্পী হিসাবে কাজ করার জন্য । তার ভাই রয় এর সাহায্যে তিনি পেসমেন-রুবিন আর্ট স্টুডিওতে একটি চাকরি যোগাড় করেন। সেখান থেকে, ডিজনি কানসাস সিটি ফিল্ম অ্যাড কোম্পানিতে চলে যান, যেখানে তার কাজ ছিল কাটআউট অ্যানিমেশনের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপন তৈরি করা। এরপর তিনি নিজের অ্যানিমেশন ব্যবসা খোলার সিদ্ধান্ত নেন। এড কোম্পানি থেকে তিনি ফ্রেড হারম্যানকে তার প্রথম কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ দেন। ওয়াল্ট এবং হারম্যান স্থানীয় কানসাস সিটি থিয়েটারের সাথে একটি চুক্তি করেছিলেন তাঁদের কার্টুন স্ক্রিন করার জন্য, যেটাকে তারা লাফ-ও-গ্রামস (Laugh-O-Grams) বলত। ধীরে ধীরে ডিজনি তার একটি নিজস্ব স্টুডিও বানাতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি আরও কর্মচারী নিয়োগ দেন। তারা ৭ মিনিট দীর্ঘ একটি এনিমেশন বানান যার নাম ছিল “ Alice in Cartoonland” । এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। কিন্তু সেই সময়ে এনিমেশন মুভি তৈরি অনেক ব্যয়সাধ্য ছিল, এবং ডিজনির স্টুডিও একসময় ঋণগ্রস্থ হয়ে পরে।
হলিউড যাত্রা-
ডিজনি এবং তার ভাই রায় সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে হলিউডে চলে আসেন। তাদের আরেক ভাই আইওয়ার্কসও ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে আসেন এবং সেখানে তারা তিনজন মিলে শুরু করেন “ডিজনি ব্রাদার্স স্টুডিও”। তাদের সাথে প্রথম চুক্তি হয় নিউ ইয়র্কের একজন প্রকাশক মার্গারেট উইঙ্কলারের সাথে, তাদের “এলিস” কার্টুন বিতরণ করার জন্য। 1925 সালে, ডিজনি লিলিয়ান বাউন্ড নামে একজন পেইন্ট শিল্পী নিয়োগ করেছিলেন। পরবর্তীতে লিলিয়ান এর সাথেই তার বিয়ে হয়।
মিকি মাউস-
ডিজনি এবং আইওয়ার্কস মিলে “মিকি মাউস” নামে একটি ইদুরের কার্টুন অঙ্কন করেন। ধারণা করা হয় যে, এই কার্টুনের চিন্তা ডিজনি একটি পোষা ইদুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পেয়েছিলেন, যেটি তিনি লাফ-ও-গ্রাম স্টুডিওতে কাজ করার সময় পুষতেন।
মিকি মাউস কার্টুন চরিত্রের উপর নির্ভর করেই নির্মিত হয় Steamboat Willie নামে একটি শর্ট-ফিল্ম। রাতারাতি এই ফিল্ম বাচ্চা-বুড়ো সবার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ডিজনি নামটি ছড়িয়ে যায় পুরো হলিউডে। ১৯২৯ সালে মুক্তি পায় Silly Symphonies নামে আরেকটি এনিমেশন চলচিত্র। এখানে মিকি মাউসের সাথে সাথে মিনি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, প্লুটো নামে মিকির কিছু বন্ধু চরিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্যবসায়িকভাবে এটি রেকর্ড আয় করে আমেরিকা আর ইউরোপের সিনেমা হলগুলোতে।
ডিজনি ব্র্যান্ড-
1937-এ রিলিজ পায় “স্নো হোয়াইট এবং সেভেন ডরফস” নামে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র। অকল্পনীয়ভাবে সিনেমাটি আয় করে $1.499 মিলিয়ন, ডলার এবং জিতে নেয় মোট আটটি অস্কার। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও প্রযোজনা করে আরও কয়েকটি ব্যাবসাসফল শিশুতোষ চলচিত্র। “পিনোচিও”, “ফ্যান্টাসিয়া”, “ডাম্বো & বম্বি” এগুলোর মধ্যে অন্যতম।
1923 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডিজনি-স্টুডিও। আজকের দিনে এই কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ কত আন্দাজ করতে পারবেন?! ১২২ বিলিয়ন ডলার। হ্যা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সিনেমা প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের নাম হল ডিজনি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বলতে গেলে ডিজনির সিনেমা-ডকুমেন্টারি সংক্রান্ত যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। ডিজনি কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি হল “অতুলনীয় গল্প বলার শক্তি দিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষকে বিনোদন দেওয়া এবং অনুপ্রাণিত করা।”
ডিজনি ল্যান্ড-
১৯৫৫ সালে সতেরো মিলিয়ন ডলার খরচ করে নির্মিত হয় ডিজনি-ল্যান্ড। এটি সমুদ্র তীরের ক্যালিফোর্নিয়া শহরে অবস্থিত। এটি মূলত বাচ্চাদের জন্য নির্মিত একটি থিম পার্ক যেখানে অসংখ্য রাইড এবং ট্রিপ এর অবকাঠামো রয়েছে। এই থিম পার্কে ঢুকতে লাগে জনপ্রতি 200$ বা ষোল হাজার টাকা। কিন্তু শিশুদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার কারণে এখানে জনসমাগম কখনও কমেনি।
ওয়াল্ট ডিজনি (Walt Disney) – রা শতাব্দী তে একবারই আসেন!
ছোটবেলায় ডিজনিকে যখন স্কুলে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি কখনও ভাল্ভাবে পাশ করতে পারেন নি কোন ক্লাস এ। তার ভাইয়ের মুখে এটাও শোনা যায় যে, ডিজনি কোনদিন খাতা কলমে সঠিকভাবে সামান্য যোগ-বিয়োগ ও করতে পারেন নি। পাঠ্যপুস্তক কখনো তাকে টানতে পারেনি। তাকে যা টেনেছে সেটি হল বই এর পাতায় আঁকা ছবি। আর সেই ছবি এঁকেই তিনি আমেরিকার ইতিহাসে নিজের নাম অক্ষয় করে রেখে গেছেন। হয়েছেন অফুরন্ত টাকা আর সম্পদের মালিক। কিন্তু কখনও তিনি ভুলে যান নি তার মূল প্রতিভা। কথিত আছে, জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি বিছানায় এঁকে গিয়েছেন ডিজনি কোম্পানির জন্য কার্টুন।
১৯৬৬ সালে ডিজনির শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই বছরেই ১৫-ই ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কল্পনার যাদুকর!