ডজকয়েন একপ্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েন, লিটকয়েন, এবং ইথেরামের মত। এই ডজকয়েন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার বিলি মার্কাস এবং জ্যাকসন পালমার তৈরি করেছিল অনেকটা মজার ছলে। ২০১২/১৩ এর দিকে অনেকগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সি বেশ হাইপ তুলতে সক্ষম হয়েছিলো। অনলাইনে যারা অত্যাধিক মিম দেখেন তারা নিশ্চই একটি কুকুরের ছবি সহ মিম দেখে থাকবেন। ঐ একই সময় কুকুরটি ভাইরাল হয়ে যায়। তখন তারা চিন্তা করলো এই আচ্ছা ‘মিম’-এর ছলে একটা ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি করলে কেমন হয়?
যেই ভাবনা সেই কাজ। বানিয়ে ফেললেন ‘শিবা ইনু’ নামের একটি আইকনিক মিম-ডগ-এর ইমোজি দিয়ে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি। তখনও পর্যন্ত অনেকে ভাবেননি এটি একটি রিয়েল ক্রিপ্টোকারেন্সি হতে যাচ্ছে, যতক্ষননা ইলন মাস্ক টুইটে ডজকয়েনকে নিয়ে টুইট করে গেলেন।
ইলন মাস্কের টুইটের পরেই মূলত ডজকয়েনের দাম হুঁ হুঁ করে বেড়ে গিয়েছে। টুইটে মাস্ক জানিয়েছিল তাঁর চন্দ্রঅভিজানে যাওয়ার জন্য স্পেসএক্স এখন পেমেন্ট হিসেবে ডোজকয়েন গ্রহন করবে। এছাড়াও ইলন মাস্কের বিশাল অংকের বিনিয়োগ আছে এই ডোজ কয়েনে।
ইলন তার আরেকটি টুইটে বলেন যে স্পেইসএস চাঁদে ডোজকয়েন রেখে আসবেন। তবে নেটিজেনরা এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর দাম আইকনিক ফিগারদের টুইটে বাড়ে কমে।
ইলন মাস্কের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ক্রিপ্টোকারেন্সিটি আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। তো চলুন শুরু করা যাক-
ডজকয়েন কী?
ডজকয়েন হলো একপ্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সি যা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার বিলি মার্কাস এবং জ্যাকসন পালমার একপ্রকার মজার ছলেই তৈরি করে ফেলেছিলেন। তবে বর্তমানে এটি জনপ্রিয় একটি ক্রিপ্টোকারেন্সিতে পরিণত হয়েছে। ধরা হয় বিটকয়েনের পরেই এই ডজকয়েনের অবস্থান।
ইলন মাস্কের এই বুস্টের মাধ্যমে ডজকয়েয়ের দাম এক লাফে ৫০০০ শতাংশে উন্নিত হয়েছে। ইলন মাস্ক আরও জানান, এটি তার একটি ফেভারিট ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ডজকয়েনের প্রথম আভির্ভাব হয় ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বরে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যপার হলো ডজকয়েন ডটকম চালু হওয়ার একমাসের মধ্যেই তাদের এই ওয়েবসাইটে প্রায় দশ লাখেরও অধিক সংখ্যক ভিজিটর পায়।
ডজকয়েন কিভাবে কাজ করে?
ডজকয়েনও বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মত এক প্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সি। যা ব্লকচেইন টেকনোলজি ব্যবহার করে। ব্লকচেইন একপ্রকার ডিস্ট্রিবিউটেড, সিকিউর ডিজিটাল লেডজার যেখানে সব ধরণের ট্রানজেকশনগুলো ডিসেন্ট্রালাইজড ভাবে সংরক্ষন করা যায়।
এই ধরণের কারেন্সিগুলো মূলত কোন প্রকার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষন না করে শুধুমাত্র ট্রানজেকশনের তথ্য সংরক্ষন করে রাখে। এখানে টাকা হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার কোন প্রকার সুযোগ নেই। একটা উদাহারণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে-
আমাদের হাতে সে সমস্ত কাগজে ছাপা মুদ্রা থাকে সেগুলোর বেশিদূর হিসেব আমরা রাখতে পারিনা। আপনার হাতের ১০০ টাকার নোটটি কয়জনের হাতবদল হয়েছে তা আপনি চাইলে সহজে জানতে পারেন না। আপনি সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন জন পূর্বের কারও সম্পর্কে জানতে পারবেন কার কার কাছ থেকে টাকাটা এসেছে।
ধরুন ১০০ টাকার নোট শুরু হয়েছে A থেকে। তারপর সেটি B তে যাবে, এরপর সেটি C তে যাবে এভাবে যেতেই থাকবে। এখন রিয়েল লাইফে হয়তো এই ধরণের মুদ্রার হিসেব আমাদের বেশি রাখা সম্ভব না। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি মডেলে এটি সম্ভব। একদম শুরু থেকে কয়েনটির হিসেব নিকেষ অনলাইনে স্টোর করে রাখা হয়।
ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের সত্যতা যাচাই করার জন্য একদল লোক নিয়মিত কাজ করে যায়। তাদেরকে বলা হয় ‘মাইনার’। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির মাইনারদের কাজকে বলা হয় মাইনিং। যদিও অনেকের মতে এই মাইনিং বিষয়টি প্রচুর পরিমানে টাইম কনজিউমিং এবং রিসোর্স কনজিউমিং। এক্ষেত্রে ডজকয়েনের ব্লকচেইন টেকনোলজিকে বলা হয়- ‘ফ্রুফ অফ ওয়ার্ক’।
ডজকয়েন বনাম বিটকয়েন-
ডজকয়েন এবং বিটকয়েনের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ডজকয়েন মাইনিং করা তুলনামুলক সহজ এবং বিটকয়েনের চেয়ে দ্রুত মাইনিং করা যায়। কারণ ডজকয়েনের মাইনিং এর ম্যাথম্যাটিক্যাল প্রবলেম গুলো ট্রানজেকশন রেকর্ডের জন্য বেশ সহজ এবং খুব সুন্দরভাবে দ্রুততার সম্পন্ন সাথে করা যায়।
ক্যাটেন’স ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট এবং রেগুলেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান, গ্যারি ডেওয়াল জানান ব্লকচেইন টেকনোলজির মাধ্যমে বিটকয়েন এর ট্রানজেকশন রেকটিফাই করতে যেখানে ১০ মিনিট লাগে, সেখানে ডজকয়েনের মাধ্যমে সেটি ১ মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন করা যায়।
দ্বিতীয়ত যে বড় পার্থক্য রয়েছে সেটি হলো বিটকয়েনে যেমন লাইফটাইম ক্যাপ রয়েছে ডজকয়েনে তেমন লাইফটাইম ক্যাপ নেই। যেমন বিটকয়েন সর্বোচ্চ ২১ মিলিয়ন পর্যন্ত ক্রিয়েট করা সম্ভব এবং এত সংখ্যক বিটকয়েন ক্রিয়েট করতে হয়তো ২০৪১ সাল নাগাদ অবধি লাগতে পারে। কিন্তু ডজকয়েনে এই কোন ধরণের লিমিটেশন নেই।
কিভাবে ডজকয়েন কিনতে হয়?
ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রি হয় এমন ওয়েবসাইট বাইন্যান্স এবং ক্রাকেন এর মাধ্যমে আপনি ডজকয়েন কিনতে পাবেন। এই এক্সচেইঞ্জ পলিসি গুলো হলো যদি আপনি এইসকল মার্কেটে ডজকয়েন নিতে চান তাহলে নির্দিষ্ট পরিমানে একটি অংক আপনাকে ইউএসডলারে জমা রাখতে হবে।
এছাড়াও কিছু অনলাইন ব্রোকার যেমন রবিনহুড, ট্রেইডস্টেশন ইত্যাদির মত ওয়েবসাইট আপনাকে অনলাইনে ডজকয়েন কিনতে সাহায্য করবে।
ডজকয়েনের ভবিষ্যত কি?
ডজকয়েনের মত যতরকম ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে সবগুলো ভবিষ্যত বলা কখনও সম্ভব নয়। এটি একপ্রকার অনুমান ছাড়া আর কিছুই না। এই কয়েনগুলো সরাসরি মুদ্রানীতিতে আঘাত না হানলেও এগুলোকে বিবেচনা করা হয়ে অনলাইন গোল্ড।
অনেকে বলে থাকে ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো ডিসেন্ট্রালাইজ এবং অনিয়ন্ত্রিত। কারও এই মুদ্রা ব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। হয়তো এগুলো বলা হয়ে থাকে সরকারি ভাবে যেন কোনভাবে নিয়ন্ত্রন না করা যায় এই জন্য। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো সরকারিভাবে বা সেন্ট্রাল ব্যাংক এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সুযোগ নেই।
কিন্তু বাস্তবতা হলো ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম কারও টুইট কিংবা কমেন্টের মাধ্যমেই পরিবর্তীত হতে পারে। যেমনটি আমরা ইলন মাস্কের টুইটে দেখলাম। ইলন মাস্কের সামান্য টুইটে ক্রিপ্টোকারন্সি ডজকয়েনের দাম আকাশ্চুম্বী হয়ে গেল।
তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি যে ভবিষ্যতের মুদ্রাব্যবস্থা হতে পারেনা তা হলফ করে বলা যায়না। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন সেলিম মনে করেন- আমরা যদি এখনও ক্রিপ্টোমুদ্রা ব্যবস্থায় প্রবেশ না করতে পারি, তাহলে আমরা বিশ্বের অন্যন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়বো। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশ ব্যংককে ক্রিপ্টোকারেন্সির অনুমোদন কিংবা লেনদেনে সহায়তা করার জন্য বলেন।
বাংলাদেশে এখন প্রচুর পরিমাণে ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। যারা বড় বড় জায়ান্ট কোম্পানীদের সাথে কাজ করেন, তাদের মধ্যে থেকে কিছু কিছু ফ্রিল্যান্সার জানাচ্ছেন যে, অনেক সময় ক্লায়েন্টরা তাদেরকে বিটকয়েনের মাধ্যমে পেমেন্ট-এর জন্য অফার করছে। তারা মনে করেন, যদি আমাদের দেশে এই বিটকয়েন না অনুমোদন দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে আমরা যারা ফ্রিল্যান্সার রয়েছি তারা বড় বড় প্রজেক্ট গুলো আর পাবো না।
যেহেতু ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো একপ্রকার ডিজিটাল গোল্ড, তাই এই কয়েনগুলো ভবিষ্যতে অনেক চাহিদা সম্পন্ন হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে যেহেতু বিটকয়েনের মত ক্রিপ্টোগুলো লিমিটেড সংখ্যক, তাই আমাদের দ্রুত এই সকম মার্কেটে প্রবেশ করে একটা অংশ দখলে নেয়া প্রয়োজন। নতুবা শেষে আমাদের জন্য কেনার মত কোন প্রকার বিট কয়েন অবশিষ্ট থাকবে না।
অনেকে এই বিটকয়েনকে স্বর্ণের খনির মত দামি বিষয় মনে করেন। একটি স্বর্ণের খনি যেমন ভাবে দেশের অর্থনীতিতে ভুমিকা রাখতে পারে, তেমনি বিটকয়েনও আগামীদিনে একই ভাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।