নির্দিষ্ট কিছু অ্যালগরিদম বা নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে যেসব প্রোগ্রাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ সম্পন্ন করে, সেগুলিকে বট বলা হয়। বটের মতোই চ্যাটবট হলো এমন এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানুষের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারে।
গ্রাহকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রডাক্ট ও সার্ভিস সম্পর্কে জানার জন্যে অনলাইনে যোগাযোগ করে থাকেন। দেখা যায়, এসব যোগাযোগে কিছু কমন প্রশ্ন থাকে গ্রাহকদের। এসব নির্ধারিত প্রশ্নের নির্ধারিত উত্তর জানানোর জন্যে অনেক প্রতিষ্ঠানেই নির্দিষ্ট কর্মীরা নিযুক্ত আছেন। তবে অনেক দিন হয়, সেসব কর্মীদের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় চ্যাটবটও গ্রাহকদের এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিচ্ছে।
তা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? আসলে যে প্রশ্নগুলি বার বার করা হয়, স্বয়ংক্রিয় ভাবে তার উত্তর দেয়ার জন্যই চ্যাটবট তৈরি করা হয়। এর ফলে যেমন অনেক কম সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের সমস্যা সমাধান করা যায়, তেমনই কাস্টমার এজেন্টদের ওপর চাপও কমে আসে। শিক্ষা, বিনোদন, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি কিংবা সংবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই চ্যাটবটের ব্যবহার এখন বাড়ছে। বর্তমানে অনেক ওয়েব সাইট বা অনলাইন প্লাটফর্মেই চ্যাটবট প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রচলিত ভাষায় এসব চ্যাটবটকে শুধুমাত্র ‘বট’ অথবা ‘ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট’ নামেও ডাকা হয়।
মানুষের সঙ্গে আলাপের মতো করেই ব্যবহারকারীরা চ্যাটবটের সঙ্গে টেক্সট বা ভয়েসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। চ্যাটবট তখন যোগাযোগকারীর লেখা বা কথা থেকে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ বা কীওয়ার্ড শনাক্ত করে পূর্বনির্ধারিত উত্তর দিয়ে থাকে।
বর্তমানে ৩ ধরনের চ্যাটবটের প্রচলন সবচেয়ে বেশি।
সেগুলি হলো-
১. রুল-বেইজড চ্যাটবট- এই ধরনের বটগুলি খুবই সরল পদ্ধতিতে কাজ করে। নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের বিপরীতে ব্যবহারকারী বা গ্রাহকদেরকে পূর্বনির্ধারিত উত্তর জানানোটাই এসব চ্যাটবটের একমাত্র কাজ। প্রাথমিকভাবে গ্রাহকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে এই বটগুলি অনেক কাজের।
২. বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন চ্যাটবট- বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এই বটগুলি ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলাপ করতে করতেই বিভিন্ন তথ্য গ্রহণ করে ও তা থেকে শিখতে থাকে। এভাবে শেখার জন্যে সাধারণত তারা মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এসব চ্যাটবট নির্দিষ্ট শব্দ এবং বাক্যাংশ বিশ্লেষণ করে সেই অনুসারে গ্রাহকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে।
৩. এআই-চালিত চ্যাটবট- ওপরের দুই ধরনের চ্যাটবটের প্রযুক্তি সমন্বয় করে তৈরি করা হয় এআই-চালিত চ্যাটবট। এই ধরনের চ্যাটবট ব্যবহারকারীদের সঙ্গে তাদের পূর্বের আলাপ-আলোচনা মনে রাখতে পারে। ফলে এসব বট গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর চাহিদাও সহজে বুঝতে পারে। এই বটগুলি গ্রাহকদের চাহিদা বুঝতে একই সঙ্গে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, মেশিন লার্নিং এবং এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ করে মানুষ এবং কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগের ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে তুলতে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং প্রযুক্তি অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
যেসব পদ্ধতিতে কাজ করে চ্যাটবট–
প্রচলিত সব চ্যাটবট মূলত ৩টি পদ্ধতিতে কাজ করে।
প্রথম পদ্ধতিটি প্যাটার্ন ম্যাচিং বট নামে পরিচিত। প্যাটার্ন-ম্যাচিং বট প্রথমে তথ্য শ্রেণিবদ্ধ করে। এরপরে সেখান থেকে তারা যেসব কীওয়ার্ড শনাক্ত করতে পারে, তার ওপর ভিত্তি করে একটি উত্তর তৈরি করে। মূলত এই পদ্ধতিতে কাজ করার জন্যে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে এআই মার্কআপ ল্যাঙ্গুয়েজ (এআইএমএল)। তবে প্যাটার্ন-ম্যাচিংয়ের ক্ষেত্রে চ্যাটবটগুলি শুধুমাত্র আগের থেকে প্রোগ্রাম করে রাখা থাকা প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে।
এখনকার চ্যাটবটগুলি যে আরেকটি পদ্ধতিতে কাজ করে, তা হলো অ্যালগরিদম ব্যবহার। গ্রাহকদেরকে সঠিক উত্তর জানানোর জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের প্রতিটি প্রশ্নের জন্যে বটের ডেটাবেজে আলাদা আলাদা প্যাটার্ন থাকে। এসব প্যাটার্নের মধ্য দিয়ে গ্রাহককে সঠিক উত্তর জানানো হয়।
তৃতীয় যে পদ্ধতিতে চ্যাটবট কাজ করে, সেটাকে কৃত্রিম বা আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক বলা হয়। এর মাধ্যমে ডেটাবেজে থাকা বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সংযোগ তৈরি করে গ্রাহককে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য জানানো হয়। চ্যাটবটের সঙ্গে মানুষ যখন আলাপ করে তখন প্রতিটি বাক্য আলাদা আলাদা শব্দে ভাগ হয়ে যায়। এবং প্রতিটি শব্দই নিউরাল নেটওয়ার্কের জন্য একেকটি ইনপুট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এভাবে সময়ের সাথে সাথে নিউরাল নেটওয়ার্ক উন্নত এবং সমৃদ্ধ হতে থাকে।
নিউরাল নেটওয়ার্কেরও বিভিন্ন ধরন ও প্রকার রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তারা নিজেদের চ্যাটবটকে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার জন্যে সময়ের সাথে সাথে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। তবে মানুষের তুলনায় যেকোনো বিষয় চ্যাটবটকে শেখানো অনেক সহজ। যেমন, একটি চ্যাটবটকে উন্নত করে তোলার জন্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার কথোপকথন বা কনভার্সেশনের তথ্য সংযুক্ত করা যায়।
চ্যাটবটের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ-
দিনে দিনে চ্যাটবট অনেক উন্নত হয়ে এলেও এই প্রযুক্তিকে নিখুঁত করে তুলতে হলে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রযুক্তিটি এখনও কয়েকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যেমন-
নিরাপত্তা- তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে গ্রাহকরা যে চ্যাটবটের সঙ্গে আলাপ করার সময় তাদের তথ্য দিচ্ছেন, তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা চ্যাটবট যেন গ্রাহকদের সঙ্গে শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক তথ্য নিয়েই আলাপ করে, সেভাবে চ্যাটবটগুলিকে ডিজাইন করতে হবে। এছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ডেটা ইন্টারনেটে নিরাপদে সুরক্ষিত রয়েছে কি না, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
ভয়েস- আজকাল চ্যাটবটগুলিকে ঠিকঠাক ভাবে কাজ করানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল, গ্রাহকদের সাথে কথা বলার সময় ভয়েস বা কণ্ঠ ঠিকঠাক রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা। গ্রাহকরা এমন কোনো চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলতে চান, যেই বটের কণ্ঠ বা কথা বলার ধরন শুনতে অনেকটাই মানুষের মতো
অনুভূতি- ঠিকঠাকভাবে কাজ করার জন্যে চ্যাটবটগুলিকে আজকালকার গ্রাহকদের আবেগ অনুভূতিও বুঝতে হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন চ্যাটবটগুলির ভাষা স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে অনেক পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে, যাতে করে গ্রাহকরা কোনো ধরনের বিব্রত পরিস্থিতিতে না পড়েন।
মোটকথা, গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা উন্নত করার ক্ষেত্রে চ্যাটবটগুলি কীভাবে কাজ করে এবং কীভাবে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হয়, সেটা বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।