গিগ ইকোনোমি বলাতে আপনার মাথায় সর্বপ্রথম ফাইবারের ‘গিগ’ কথা চিন্তায় এসেছে? যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে আপনি অবশ্যই ভুল নন। কারণ ফাইভারের ‘গিগ’ও গিগ ইকনমির একটি অংশ। ফাইভার এবং অন্যান্য ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে আমরা দেখি ছোট ছোট কন্ট্রাক্ট এর মাধ্যমে কাজ গুলো সম্পাদন করে দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে বড়-ছোট কন্ট্রাক্ট হয়ে থাকে। মার্কেটপ্লেসের এই ছোট ছোট কাজগুলো সৃষ্টি করেছে এক নতুন অর্থনীতি।
আজকে আমরা কথা বলবো এই গিগ ইকোনমি নিয়ে। জানবো কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের প্রতিটি দেশে এই টেমপরারি, ফ্লেক্সিবল জবগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসছে সেই সম্পর্কে।
গিগ ইকোনমি কি?
ফুলটাইম কাজের পরিবর্তে ছোট ছোট কন্ট্রাক্ট-এর মাধ্যমে ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর এবং ফ্রিল্যান্সার হায়ার করার ফলে যে অর্থনীতি সৃষ্টি হয়েছে, তাই গিগ ইকোনমি। এই ইকোনমিতে গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে, কর্মী হায়ার করতে হয়।
ফ্রিল্যান্সার হায়ার করা কিংবা রিমোটলি কারও জন্য কাজ করার সময় অর্থ লেনদেন হয়। কেউ তো আর ফ্রীতে কিছু করে দেয় না। বিনিময় প্রথার মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অর্থ পাঁচ ডলার থেকে শুরু করে দশ হাজার ডলার বা তারও অধিক হতে পারে। এই যে এত পরিমান অর্থ প্রতি ইন্ডিপেনডেন্ট ওয়ার্কার-এর জন্য ব্যয় করা হয়, কিংবা কাওকে হায়ারিং এর জন্য ব্যয় করা হয় এগুলো কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে বিরাট একটা ভুমিকা রাখে।
তবে সবাই ভয় করে এই লেনদেনের সঠিক হিসেব সরকারের কাছে পুরোপুরি পৌঁছায় না। তাই এই ধরণের অর্থনীতির আকার নির্ণয় করা কষ্ট সাধ্য।
ইন্ডিপেনডেন্ট ওয়ার্কের মাধ্যমে যে ইকনমি সৃষ্টি হয়েছে তাই গিগ ইকোনমি।
গিগ জব কি?
গিগ জব গুলো হচ্ছে ছোট ছোট কন্ট্রাক্ট এবং শর্ট টাইম কন্ট্রাক্ট-এর মাধ্যমে কোন সিঙ্গেল কোম্পানির সাথে স্বাধীনভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করা। এই ধরণের জবের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। প্রচলিত জবের তুলনায় এই জবগুলো ফ্লেক্সিবল হওয়ার কারণে সবার আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে। ফ্রিল্যান্সাররা যে ধরণের জব করে তাই হচ্ছে গিগ জব।
গিগ ওয়ার্কার কারা?
ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর, অনলাইন প্লাটফর্মে কাজ কর, কন্ট্রাক্ট ফার্ম এবং টেম্পরারি কর্মীদের গিগ ওয়ার্কার বলে। আরও সহজ করে বললে মূলত ফ্রিল্যান্সাররা হচ্ছে গিগ ওয়ার্কার। গিগ ওয়ার্কারদের ট্রেডিশনাল থেকে বেশি স্বাধীনতা থাকায় এই সেক্টর অনেকের আগ্রহের শেষ নেই, ফ্রিল্যান্সাররা মূলত গিগ ওয়ার্কার।
কিভাবে গিগ ইকোনমি বহির্বিশ্বে প্রভাব ফেলছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ শতাংশ নাগরিক কোনো না কোনো ভাবে গিগ ইকোনমি সাথে সংযুক্ত। এদের মধ্যে কেউ হয়তো প্রাইমারি জব হিসেবে গিগ ইকোনমিতে অবদান রাখছে আবার কেউ সেকেন্ডারি জব হিসেবে এই ইকোনমিতে অবদান রেখে চলেছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে গিগ কর্মীদের। বড় হতে শুরু করেছে গিগ ইকনমির পরিধি।
তবে গিগ ইকোনমিতে অবদান প্রত্যেকটি দেশের সমান নয়। কোন দেশের গিগ ইকোনমির আয়তন অনেক বড়। আবার কোন দেশের তুলনামূলক কিছুটা কম। শুধু আমেরিকায় বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষের অধিক মুক্ত পেশাজীবি ফ্রিল্যান্সের সাথে যুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ২০১৬ সালের পর থেকে তিন গুন দ্রুত বাড়ছে।
গিগ ইকোনমির কারণে বিশ্বের অনেক দেশের অনেক রকম সুবিধে হচ্ছে। এই গিগ ইকোনমির মাধ্যমে সবাই কম বেশি সুবিধা নিচ্ছে। যেমন কোন কম্পানীর যদি একজন ওয়েব ডেভেলপার-এর প্রয়োজন হয়, তাহলে পূর্বের নিয়মে তাদের একজনকে ফুলটাইম হায়ার করতে হতো। এতে করে খরচ এর পরিমান বেড়ে যেত। হয়তো কাজটি ২০ দিনে শেষ হয়ে যাবে। এরপর সেই কর্মীকে দিয়ে কোন কাজ করানো যায় না। এতে করে কোম্পানীর লস হয়।
কিন্তু গিগ ইকোনমি সৃষ্টি হওয়ার ফলে কম্পানীগুলো তাদের প্রয়োজন মত কর্মী হায়ার করতে পারছে। এই ইকনমির সাথে যারা যুক্ত তাদের কাজের জন্য যেটুকু বরাদ্দ শুধু ঐটুকুর টাকা দেয়া হয়। এখানে কোন প্রকার হেলথ ইন্সুরেন্স, ফেসটিবল বোনাস সহ অন্যান্য কোন প্রকার খরচ করতে হয় না। অর্থাৎ কর্মীর পেছনে কম্পানীর খরচ অনেক কমে যায়।
তাই উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো গিগ ইকনমির ফলে প্রয়োজন মত ফ্রিল্যান্সার হায়ার করে তাদের খরচের পরিমান অনেক আংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে।
কেন সবাই টেম্পরারি জবের পেছনে ছুটছে?
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির দেশে কিংবা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির যে কোনো দেশে সেকেন্ডারি জব ম্যানেজ করার অনেক সুযোগ থাকে। যেমন রেস্টুরেন্টে কাজ করা থেকে শুরু করে ড্রাইভিং সহ বিভিন্ন রকম টেম্পোরারি জব ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি গুলোতে এই ধরনের জব ফেসিলিটি নেই। বরং এখানে ইকনমি ছোট হওয়ায় এখানকার তরুণেরা বা বয়স্করা কোন ভাবেই নিজেদের স্কিল গুলো সেল করতে পারে না।
সে দিক থেকে গিগ ইকোনমি সবাইকে একটা বিশাল সুযোগ করে দিচ্ছে পার্ট টাইম কাজ করার জন্য। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, এবং ফিলিপাইনসহ অন্যান্য অনেক দেশে ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার এই সকল দেশের গিগ ইকোনমি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনা পেনডেমিকের কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ চাকুরি হারিয়েছে। তাদের অনেকে বাড়িতে হবে বেকার সময় কাটাচ্ছে। আবার এদিকে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস গুলো আগের থেকে অনেক বেশি সরব হয়ে উঠেছে এবং ব্যবহার বিধিও সহজ করেছে। ফলে অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিজেদের এই গিগ অর্থনীতিতে নিজেদের জড়িয়েছে।
এছাড়া এই ধরণের জবে বিশেষ সুবিধে হলো ইচ্ছেমত সময়ে কাজ করা যায়। প্রয়োজন মত ছুটিও নেয়া যায়। যেগুলো ট্রেডিশনাল জবে সব সময় সম্ভব নয়। সেই সাথে পরিবারের সাথে থেকে আয় করার মত লোভনীয় দিক থাকায় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই ফ্রিল্যান্স সেক্টর।
গিগ অর্থনীতিতে বাংলাদেশ-এর অবস্থান-
গিগ ইকোনমিতে বাংলাদেশের অবস্থান দিন দিন শক্তপোক্ত হচ্ছে। রাইডিং অ্যাপ্স থেকে শুরু করে ফুড, হেলথ, ই-কমার্স সহ বেশ কিছু সেক্টর বাংলাদেশে বেশ ভালো করছে। দক্ষিন এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশের অবস্থান বলে অনেকে মনে করছে।
এই অর্থনীতিতে বাংলাদেশ প্রায় ১৬% এর বেশি অবদান রাখছে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ লক্ষের অধিক নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ শখের বসে খুললেও এখানকার সাফল্যের হার অনেক বেশি। বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল অবস্থায় বাংলাদেশের মত একটি দেশে ফ্রিল্যান্সিং একটি আশির্বাদ হিসেবে ফিরেছে।
গিগ ইকোনমির ভবিষ্যত-
আপওয়ার্কের তথ্য মতে আমেরিকার ৪১ শতাংশ কর্মী রিমোট জব করেছেন। ২০২১ সালে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন আমেরিকান রিমোটলি জব করছে। লিংকেডইনের তথ্যমতে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২৫৫ মিলিয়ন কর্মী রিমোট জব করবেন। ফ্লেক্সিবল হওয়ার কারণে এই সেক্টরের দ্রুত প্রসার ঘটছে। দিন দিন সবাই রিমোট জব পছন্দ করার কারণে এই ইকোনমির আয়তন বেড়ে চলছে।
এর মধ্যে অনেকে আবার রিমোট+অফিস দুই ধরণের সব একসাথে পছন্দ করেন। অর্থাৎ কর্মী তাঁর সময় অনুযায়ী কাস্টমাইজেশন করে নিয়ে কাজ করতে পারবে এমন আগ্রহের অনেকের দেখা মিলেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায় গিগ ইকোনমির আয়তন দিন দিন বাড়বে। কারণ ইন্ডিপেনডেন্ট ওয়ার্কারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকে আবার অফিস পলিটিক্স সহ নানা রকম ঝামেলা এড়াতে রিমোট জব বেশি প্রেফার করে থাকেন।
Comments 1