ক্রিপ্টোগ্রাফি (CryptoGraphy) নামে কম্পিউটার প্রকৌশলে একটি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হয়। এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়- তথ্যগুপ্তিবিদ্যা। এটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের নিরাপত্তা এবং যোগাযোগ বিষয়ক একটি শাখা, যাতে তথ্য গোপন করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে গবেষণা করা হয়। এটিএম কার্ড, একাউন্ট পাসওয়ার্ড, বা ই-কমার্স- এর ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেন নিরাপত্তা একটি জরুরী বিষয় । এসব ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোগ্রাফি (CryptoGraphy) অত্যাবশ্যক একটি প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে । এর সর্বশেষ অবদান হল ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল সাংকেতিক মুদ্রা। এই মুদ্রা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের প্রথমে এর সঞ্চালন প্রযুক্তি “ব্লকচেইন” নিয়ে ধারণা থাকা দরকার। চলুন প্রথমেই জেনে নেই, ব্লকচেইন কি?
ব্লকচেইন এক ধরনের চেইন বা শিকল । চেইন বা শিকল কি সেটা কারো অজানা নয় । অনেকগুলো একই ধরনের ধাতু/আংটা পাশাপাশি একটির সাথে আরেকটি যোগ করার মাধ্যমে সেগুলোকে একটি শিকলের মত করাকেই চেইন বলা হয়। ব্লকচেইন তথ্য রেকর্ডিংয়ের এমন একটি ব্যবস্থা যা সিস্টেমটিকে পরিবর্তন করা, হ্যাক করা বা প্রতারণা করা অসম্ভব করে তোলে। ব্লকচেইন হল মূলত লেনদেনের একটি ডিজিটাল লেজার যা ব্লকচেইনে কম্পিউটার সিস্টেমের পুরো নেটওয়ার্ক জুড়ে নকল করে বিতরণ করা হয়। প্রতিটি সময় ব্লক চেইন-এ নতুন লেনদেন হয়, সেই লেনদেনের একটি রেকর্ড প্রতিটি অংশগ্রহণকারীদের খাতায় যুক্ত হয়। যে ব্লকগুলোর দ্বারা এই চেইনটি তৈরি করা হয়; সেই ব্লকগুলো মূলত তথ্য সংরক্ষণ করে। ব্লকচেইনের ব্লকগুলোর মধ্যে যখন একটি ডেটা/তথ্য যোগ করা হয়, তখন ওই ডেটাটিকে মুছে দেয়া বা ডেটাটির কোন প্রকার পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সেটা কিভাবে নিশ্চিত করা হয়?
এটা জানতে হলে প্রথমে আপনাকে জানতে হবে যে এই ব্লক গুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি ব্লকে আসলে কি থাকে। সম্পূর্ণ ব্লকচেইনের প্রত্যেকটি সিঙ্গেল ব্লকে মূলত তিনটি জিনিস থাকে- ডেটা-হ্যাশ (HashCode) এবং চেইনে এর আগের ব্লকের হ্যাশ। কিন্তু হ্যাশ জিনিসটা কি? হ্যাশ হচ্ছে মূলত একটি আইডেন্টিফায়ার। প্রত্যেকটি ব্লকের হ্যাশ (HashCode) সম্পূর্ণ মৌলিক। অর্থাৎ, দুটি ব্লকের হ্যাশ কখনো একই হতে পারবে না। এই বিষয়টি অনেকটা মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মত। দুটি মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট যেমন এক হয় না; তেমনি দুটি ব্লকের হ্যাশও কখনো এক হতে পারবে না । আর এই হ্যাশগুলো জেনারেট হয় প্রত্যেকটি ব্লকের স্টোর করা ডেটা অনুযায়ী। অর্থাৎ, একটি ব্লকের ডেটা যদি কোনরকম পরিবর্তন করা হয়, তাহলে ওই ব্লকটির হ্যাশও চেঞ্জ হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, প্রত্যেকটি ব্লক কেন তার আগের ব্লকের হ্যাশও থাকে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি সহজভাবে একটি বিকেন্দ্রীভূত খাতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যেখানে একটি ডিজিটাল তথ্যের আদান-প্রদান সুষমভাবে লিপিবদ্ধ করা থাকে। আর এই অভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে চালু করা হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি বা মুদ্রা। কোন সরকার বা রাষ্ট্র এটি উৎপাদন করে না বা যোগান দেয় না। ক্রিপ্টোকারেন্সি হল একটি ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা যা ক্রিপ্টোগ্রাফি দ্বারা সুরক্ষিত থাকে , যা জাল করা প্রায় অসম্ভব। ক্রিপ্টো মুদ্রা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা অনেকদিন ধরে চলছে প্রযুক্তি জগতে। ক্রিপ্টোগ্রাফি থেকে যে মুদ্রা ব্যাবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব, সেটা গবেষকরা ওনেক আগেই উপলব্ধি করেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত সকল সমস্যার সমাধান একসাথে করতে ব্যর্থ হন তারা। অবশেষে, ২০০৮ সালে অজানা এক গবেষক (মতান্তরে জাপানের সাতোশি নাকামতো নামে এক ব্যাক্তি) নির্ভুলভাবে সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। আর তার দেয়া সেই সমাধানের নামই হল ব্লক-চেইন। ব্লকচেইন এলগোরিদম প্রক্রিয়ায় একটি কয়েন জেনারেট/উৎপাদন হতে প্রথম দিকে সময় খুব কম সময় (৫ মিনিট) লাগলেও সময়ের সাথে সাথে এর জটিলতা বাড়তে থাকে। বর্তমানে, একটি কয়েন ১৫ দিনেরও বেশি সময় নিয়ে উৎপন্ন হয়। আর এই প্রক্রিয়ার জটিলতার উপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হয় ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম বা রেট। Bitcoin, OneCoin, Dogecoin এগুলো হল বর্তমানে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বাধিক অনুমোদনপ্রাপ্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ক্রিপ্টো মুদ্রার সুবিধা কী?
মানব-জীবন যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পৃথিবীর মুদ্রা ব্যবস্থার অনেক বিবর্তন ঘটেছে। স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা থেকে সেটা কাগুজে মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। বাজারে নকল মুদ্রার প্রবেশ ঠেকাতে উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড এর মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থা গ্রাহকের লেনদেন সেবাকে আরও দ্রুততর করা হয়েছে। এগুলোকে ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ বলা যেতে পারে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময়, এগুলো হ্যাক হয়, অথবা টাকা চুরি হয় অনলাইন স্ক্যামারদের মাধ্যমে। সবচেয়ে অভাবনীয় অগ্রগতি এনেছে যেই মুদ্রা সেটি হল ক্রিপ্টো মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি।
১। এর কোনো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই। পৃথিবীজুড়ে এর ব্যাবহারকারী সবাই একধরনের নিরাপদ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই মুদ্রার প্রচলন করছে। কেউ নীতিনির্ধারক নয়, সবাই সমান, নেটওয়ার্কের একটি অংশ বা নোড মাত্র। ক্রেতা থেকে বিক্রেতার কাছে সরাসরি, কারও মধ্যস্থতা ছাড়াই, নিরাপদ ও নিশ্চিতভাবে এই মুদ্রা আদান প্রদান করা যায়। এই মুদ্রাব্যবস্থার কোনো কেন্দ্রীয় রূপ নেই, এখানে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে।
২। বিটকয়েনের ফলে এক মুহূর্তে যে কেউ বাংলাদেশ থেকে জাপানে মুদ্রা পাঠিয়ে কোনো কিছু কিনতে পারবে। কোনো ব্যাংকের ব্যাপার নেই, কোনো মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যাপার নেই। মধ্যবর্তী কোনো সংস্থা নেই। তবে অবশ্যই এই কেনা বেচা আইনত অনুমতি সহ হতে হবে।
৩। তড়িৎ গতিতে এই মুদ্রা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ট্রান্সফার করা সম্ভব। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময় লাগছে এখন। কিন্তু অন্য কিছু ক্রিপ্টো মুদ্রা আরও কম সময়ে ট্রান্সফার করা যায়। বর্তমান মুদ্রা স্থানান্তর ব্যবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল মানি ট্রান্সফার -এ কয়েক দিন লেগে যায়।
৪। এই মুদ্রা প্রেরকের কাছ থেকে গ্রাহকের কাছে পাঠাতে সুনির্দিষ্ট ফি লাগে। এটি পাঠানো অর্থের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। এক বিটকয়েন আর এক লাখ বিটকয়েন পাঠাতে একই ফি লাগে । বর্তমান মানি ট্রান্সফারে যেটি কখনও হয়না।
৫। ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন এর ক্ষেত্রে কোন নকলের আশ্রয় বা জাল করা যায় না। একবার ট্রান্সফার হয়ে গেলে কোনোভাবে ফিরিয়ে নিতে বা পরিবর্তন করা যায় না। এই লেনদেন অপরিবর্তনীয়। ফলে জালিয়াতির সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।
বিটকয়েনের সম্ভাবনা-
গত এক দশক ধরে বিটকয়েনের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে— নিকট ভবিষ্যতে হয়ত পৃথিবীজুড়ে সবাই ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবহার করবে। এটিকে এভাবে বোঝানো যায়, কেউ যদি ২০ বছর আগে বলত; পৃথিবীজুড়ে সবাই স্মার্টফোন ব্যবহার করবে, সেটা হয়তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। এখানেও ঠিক তেমনটি ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এছাড়া, বিটকয়েনের সংখ্যা সীমিত। তাই একটি বিটকয়েনের দাম অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। যোগান সীমিত হলে সেই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, এটা আমরা সবাই জানি।
বিটকয়েন মূল্য হঠাৎ কমে গেল কিভাবে?
২০২১ সালের মে মাসের শুরুতে হঠাৎ করে বিটকয়েনের দাম পড়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি এলন মাস্ক প্রায় ৫-বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বিটকয়েনের মালিক। টেসলা কোম্পানির গাড়ী কেনার ক্ষেত্রেও বিটকয়েন ব্যাবহারের অনুমতি ছিল। তবে সম্প্রতি এই কোম্পানি সেটি বন্ধ করে দেয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং এর জন্য পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। এবং এর প্রভাব পুরো ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে পড়ে। দাম ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে এই মুদ্রার। তবে আশার কথা হল, এলন মাস্ক সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি পরিবেশবিদদের সাথে আলোচনা করেই, সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।