ইলন মাস্ক কে ধরা হয় বর্তমান বিশ্বের একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। জীবনে বারবার ব্যর্থ হয়েও অদম্য এই ব্যক্তিত্ব পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করেছেন অসাধারণ কর্মযজ্ঞ। যিনি ইকোনমিক্স ব্যাকগ্রাউন্ডের ছাত্র হয়েও সফল ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছেন বিজ্ঞানে। এই ব্যক্তিটি তার অসাধারণ উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় আমাদের বর্তমান বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে চলছে বহুদূর।
মহাকাশ ভ্রমণ যেখানে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল সেখানে ইলন মাস্ক তার ব্যবসায়িক পলিসি ব্যবহার করে সবার জন্য মহাকাশ ভ্রমণের ব্যবস্থা তৈরি করছে। ইলন মাস্কের চিন্তাভাবনা কতটা বিশাল সেটি তার স্পেইস-এক্স এবং মহাকাশ নিয়ে চিন্তাভাবনা দেখলেই আঁচ করা সম্ভব।
ইলন এমন সব বড় প্রজেক্টে হাত দেন যেখানে সাধারণ মানুষ কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। হয়তো তার এই অসাধারণ চিন্তাভাবনার কারণেই তিনি আজ অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। মহাকাশ কিংবা পৃথিবীপৃষ্ঠ, সব সবখানে ইলন মাস্ক পরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ইলেকট্রিক কারের দুনিয়ায় অলরেডি রেভ্যুলেশন সৃষ্টি করে বসে আছে।
এই ইলন মাস্কের জীবনী নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা। চলুন জেনে নেয়া যাক আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-
কে এই ইলন মাস্ক?
ইলন মাস্ক হলেন একজন অসাধারণ উদ্যোক্তা, যিনি পে্পাল-এর কো-ফাউন্ডার, টেসলা, স্পেস এক্স নিউরালিংক এবং বোরিং কোম্পানির স্বত্বাধিকারী। যিনি বর্তমানে টেসলার সিইও এবং স্পেইস-এক্স-এর সিইও এবং লিড ডিজাইনার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও তিনি পৃথিবীর বর্তমান সর্বোচ্চ ধনীলোকদের মধ্যে একজন।
ছেলেবেলার গল্প-
ইলন মাস্ক জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭১ সালে সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। ইঞ্জিনিয়ার বাবা এবং নিউট্রিশনিস্ট মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়, যখন ইলনের বয়স ১০ বছর ছিল তখন। পরবর্তীতে মাস্ক তার বাবার তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। এসময় তাকে অনেক ঝড়-ঝাপটা মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছিল।
এক টকশোতে ইলন আফসোস করে বলেন, তাঁর ছেলেদের জীবনে খুব একটা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে না। এটা নিয়ে তিনি চিন্তিত। কারণ জীবনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন না হলে খুব একটা সফল হওয়া যায় না। এটা হয়তো তিনি বেশ ভালই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে।
ছেলেবেলা থেকেই ইলনের কম্পিউটারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল। নিজেই প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখা শুরু করেছিলেন সেই সময়টিতে। তার বয়স যখন .১২বছর ছিল, তখন সে অলরেডি একটি গেমিং সফটওয়্যার বিক্রিও করে ফেলেছিল যার নাম ছিল ব্লাস্টার(Blaster)।
স্কুল বয়সে ইলন ছিল খুব ইন্ট্রোভার্ট, খাটো, এবং বইপড়ুয়া। যার ফলে তাকে অনেক বুলিং-এর শিকার হতে হয়েছিল। পরবর্তীতে সে নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য কেরাটি এবং রেসলিং শেখা শুরু করেছিলেন।
শিক্ষাজীবন-
১৯৮৯ সালে ইলন মাস্কের বয়স ছিল ১৭ বছর। তখন তিনি কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হন। এরপর তিনি একই বছর কানাডা সিটিজেনশিপ নিয়ে নেন। কারণ তিনি চিন্তা করে রেখেছিলেন কানাডা সিটিজেনশিপ নিয়ে রাখতে পারলে আমেরিকান সিটিজেনশিপ পাওয়ার পথটা আরো সহজ হবে।
১৯৯২ সালে আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া’তে ফিজিক্স এবং বিজনেস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার প্রথম ব্যাচেলর ডিগ্রি ছিল ইকোনমিক্স এবং পরবর্তীতে সে পুনরায় ব্যাচেলর ডিগ্রী করেন ফিজিক্সে। পেনসিলভেনিয়া ছেড়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়াতে ‘এনার্জি ফিজিক্স’-এ পিএইচডির জন্য ভর্তি হন।
এই সময়টাতেই সারা বিশ্বে ইন্টারনেট-এর রেভ্যুলেশন চলছিল। বিভিন্ন ব্যবসায়িক চিন্তা ভাবনা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা ভাবনার মননিবেশের কারণে তাকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ড্রপ আউট হতোনিবেশের.১৯৯৫ সালে সে তার প্রথম কোম্পানির Zip2 কর্পোরেশন চালু করে। এবং ২০০২ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করে।
Zip2 কর্পোরেশন-
ইলন মাস্ক এবং তার ভাই কিম্বল মাস্ক দুজনে মিলে তাদের প্রথম কোম্পানি Zip2 কর্পোরেশন শুরু করেন। এটি ছিল এক প্রকার অনলাইন সিটি গাইড যারা সেসময় নিয়োগ টাইমস এবং শিকাগো ট্রিবিউন’কে কন্টেন্ট প্রোভাইড করতো। এটি মূলত ম্যাপ এবং টেলিফোন নাম্বার সার্চ করে খুঁজে বের করার একটি মাধ্যম ছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে Compaq কম্পিউটার কর্পোরেশন এটিকে ৩০৭ মিলিয়ন ক্যাশ এবং ৩৪ মিলিয়ন ডলারের স্টক-এর বিনিময়ে অধিগ্রহন করে নেয়।
পেপাল-
Zip2 কর্পোরেশন সেল করে দেয়ার পর এই টাকা দিয়ে ইলন এবং কিম্বল মাস্কপ্রতিষ্ঠা করেন x.com। এটি ছিল একটি ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এবং পেমেন্ট গেটওয় সিস্টেম অনেকটা বিকাশ এর মত। যেখানে তাৎক্ষণিক মানিট্রান্সফার করা যেত। তখনকার X.Com রুপান্তরিত হয় পেপালে। এরপর ২০০২ এর অক্টোবরে eBay পেপালকে অ্যাকয়ার করে নেয়।
স্পেইস-এক্স
ইলন মাস্ক-এর পেপাল বিক্রি করার পেছনে বড় উদ্দেশ্য ছিল স্পেইস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজি কর্পোরেশন বা স্পেইস-এক্স প্রতিষ্ঠিত করা। ২০০২ সালে মাস্ক তার পকেটের ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতিষ্ঠা করে এই ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল কম্পানিটি।
এরপর মাস্ক স্পেইস-এক্স এর সুবাধে নাসা এবং আমেরিকান মিলিটারি ফোর্স-এর সাথে রকেট ডিজাইন এবং মিলিটারি মিশন কার কাজের কন্ট্রাক্ট করে। ইলন মাস্ক এর ভাষ্যমতে ২০২৫ সালের মধ্যে নাসার সহযোগীতায় নভোচারীদের মঙ্গলে পাঠানো সম্ভব হবে।
ইলন মাস্ক যখন মহাকাশ জয়ের চিন্তা করছিলেন তখন তিনি দেখলেন মহাকাশে পাঠানো রকেট গুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। তিনি দেখলেন রকেট গুলো যদি পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব হয় তাহলে মোট খরুচ এর পরিমান অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। যদিও বা শুরুতেই সফলতা ধরা দেয়নি, কিন্তু তিনি যে থামে যাওয়া মানুষ নন।
২০১২ সালের মে’তে স্পেইস-এক্স লঞ্চ করে ফেলকন-৯ রকেট যেটি সফল ভাবে ইন্টারন্যাশানাল স্পেইস স্টেশনে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এটি ছিল একমাত্র প্রাইভেট স্পেইসক্র্যাফট যারা ১০০০ পাউন্ড ওজনের সাপ্লাই সফল্ভাবে ইন্টারন্যাশানাল স্পেইস স্টেশনে পৌছাতে সক্ষম হয়।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি স্পেইসক্র্যাফট ফেলকন-৯ সফল ভাবে স্যাটেলাইট বহন করে জিওসিনক্রোনাসে পৌছাতে সক্ষম হয়।
এরপর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেইস-এস লঞ্চ করে আরেকটি ফেলকন-৯ যেখানে ডিপ স্পেইস ক্লাইমেট অবজারবেশন স্যাটেলাইট পাঠানো সম্ভব হয়। যার মূল লক্ষ ছিল, সূর্য রশ্নি থেকে যেসকল ইক্সট্রিম ইমিশন হয় সেগুল অবজারবেশন করা, যেগুলো পৃথিবীতে কমিউনিকেশন সিস্টেমকে ব্যঘাত করে।
২০১৭ সালের মার্চে পাঠানো ফ্যালকন-৯ এর যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়েছিল পূর্বেকার পাঠানো ফ্যালকনগুলোর যন্ত্রাংশ দিয়ে। ফলে মহাকাশযানের দুনিয়া নতুন দুয়ার খুলে খুলে যায় এবং স্পেস ট্রাভেলকে আরো অ্যাফোর্ডেবল করার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
২০১৮ সালে জুলাই-এ স্পেইস-এক্স এর ব্লক-৫ ফেলকন রকেট সফল ভাবে ল্যান্ড করে ড্রোনশিপের মাধ্যমে, যেটি প্রায় ৯ মিনিট অবধি আকাশে ছিল।
২০১৮ সালে মার্চে স্পেইস-এক্স ইউএস গভর্নমেন্ট থেকে পারমিশন পায় লো-অরবিটে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদানের লক্ষে স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য। এই প্রজেক্টটি নাম হচ্ছে স্টারলিংক। এর মাধ্যমে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। যেসকল দূর্গম এলাকায় ইন্টারনেট যোগাযোগ করা সম্ভব হয়না সেসকল এলাকায় স্টারলিংক-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করা সম্ভব হবে।
ইলন মাস্ক কতটা ধনী?
২০২১ সাল নাগাদ, ইলন মাস্ক হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে দ্বিতীয়। তার মোট সম্পদের পরিমান প্রায় ১৫১ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ-
ইলন মাস্ক-এর জীবনী থেকে আমরা দেখতে পাই তার ইন্টারেস্ট এর জায়গাগুলো ছিল ফিলোসফি, সাইন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি নোবেল। যেগুলো সে পরবর্তীতে তার আইডিওলজি থেকে বিজনেস ক্যারিয়ারে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে ইন্টারনেট, রিনিউয়েবল এনার্জি রিসোর্স, স্পেইস কলোনাইজেশন ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্ব অনেক এডভান্স করে দিচ্ছে তার এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তি দিয়ে। এছাড়াও তার অন্যতম উদ্ভাবন পেপাল, টেসলা মোটরস, সোলার সিট্ স্পে-এক্স প্রযুক্তি দুনিয়ায় তাকে এক অনন্য স্থান তৈরি করে দিয়েছে।