যেকোনো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ম্যানেজাররা নিজেদের যেসব দক্ষতা কাজে লাগান, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সক্রিয় চিন্তাভাবনা করার কাজ। তা করতে গিয়ে তাদেরকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। আবার, সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ম্যানেজাররা সাধারণত ২টি উপায়ে চিন্তাভাবনা করেন। প্রথমত, নিজেদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে অনুমান করা আর দ্বিতীয়ত, সচেতনভাবে হিসাব-নিকাশ করে সমাধান বের করা। বর্তমানে কম্পিউটার এই উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। নির্ভুলভাবে হিসাবনিকাশ করতে পারায় কম্পিউটার সহজেই সচেতন বা যুক্তিযুক্ত কাজে মানুষকে হারাতে পারে। তবে এর জন্যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা নিয়মকানুন অনুসারে আগে থেকেই কম্পিউটার প্রোগ্রাম করে রাখতে হয়।
প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য পোর্টফোলিও তৈরি, প্রোডাক্টের মূল্য নির্ধারণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাপ্লাই-চেইনের বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে আগাম ধারণা পেতে ম্যানেজাররা এখন কম্পিউটারের সাহায্যে অপ্টিমাইজেশন এবং সিমুলেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এসব কাজে বিভিন্ন প্যাটার্ন শনাক্ত করতে হয়, যাতে কম্পিউটারের তুলনায় মানুষের সক্ষমতাই বেশি। তবে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে কম্পিউটারও এখন এমনভাবে প্রোগ্রাম করা হচ্ছে, যাতে বিপুল পরিমাণ ডেটা থেকে নিখুঁতভাবে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়।
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় টমোগ্রাফি স্ক্যানের মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্ত করা এবং বিনিয়োগের জন্য টার্গেট বেছে নেয়ার মতো কাজে মানুষের চেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে কম্পিউটার। অথচ এ ধরনের কাজে এতদিন মানুষকেই বেশি সক্ষম হিসেবে মনে করা হতো।
মোটকথা, বর্তমানে যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কি ম্যানেজার হিসেবে মানুষের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে? এর উত্তর হলো, হ্যাঁ, থাকবে। কারণ, সৌভাগ্যবশত মানুষ এখনও কম্পিউটারের চেয়ে একটি বিষয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর সেটা হলো, ধীরস্থির ভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা।
মানুষের ধীর গতিতে চিন্তা করার এই বৈশিষ্ট্য কীভাবে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়েও গবেষণা করা হচ্ছে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত এটাকে ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্যা হিসাবে না দেখে এআই প্রযুক্তির সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এআই প্রযুক্তিতে মানুষের এই বৈশিষ্ট্য প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। মূলত, এআই হলো পূর্বাভাস বা অনুমান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একধরনের অ্যালগরিদম। অথচ যেকোনো সমস্যা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করার জন্য বাড়তি সময়, মানুষের বিচারবুদ্ধি এবং সতর্ক বিশ্লেষণের দরকার হয়। এ কারণে বীমা ব্যবস্থায় জালিয়াতি চিহ্নিত করা বা আবেদনকারী ঋণ পাওয়ার যোগ্য কিনা, তা মূল্যায়নের মতো কাজ মানুষেরই করতে হয়।
বর্তমানে ম্যানেজাররা কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করেই নিজেদের কাজের দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন। তবে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে ভবিষ্যতে ম্যানেজারদের যেকোনো বিষয় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতাকেই গুরুত্ব দেয়া হবে। এই সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে, এমন ৪টি কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো এখানে।
কিছুটা সময় চিন্তামুক্ত থাকা-
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিছুটা সময় সমস্যা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং চিন্তামুক্ত থাকতে পারলে তাতে আরও সৃজনশীল সমাধান মাথায় আসে। চিন্তামুক্ত থাকার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ইনকিউবেশন। যখন একটি সমস্যা কিছু সময়ের জন্য মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, তখন সেই সমস্যা নিয়ে তৈরি হওয়া দৃষ্টিকোণ থেকেও নিজেকে দূরে রাখা হয়। এর ফলে সমস্যাটি ভিন্ন ভাবে দেখার এবং সেটা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি হয়। সুতরাং কোনো সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু করার পরে কিছু সময়ের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু করুন। এতে মস্তিষ্কের অবচেতন পর্যায়েই ধীরে ধীরে সমস্যাটির জট খুলবে।
বিভিন্ন অনুমান নিজের কাছেই স্পষ্ট করা-
বেশিরভাগ সময়ই আমাদের অবচেতন মনে থাকা সীমাবদ্ধ বিভিন্ন অনুমান সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকি না। অথচ সেসব অনুমান মাথায় নিয়েই আমরা বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করি। তবে আলোচনা বা বিতর্কের মাধ্যমেই সেসব অনুমান আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে। সেজন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে একাধিক কর্মীর মতামত জানতে পারেন। অথবা কর্মীদেরকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতিটা গ্রুপকে বিপরীতভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করতে বলতে পারেন। এক্ষেত্রে সমস্যার গাণিতিক মডেল তৈরি করাও সহায়ক হতে পারে। এভাবে যেকোনো সমস্যার কারণ কী এবং তার প্রস্তাবিত সমাধানগুলি কীভাবে কাজ করার কথা, তা নিয়ে নিজের মধ্যে থাকা অনুমান স্পষ্ট হবে। মডেলিং করার মধ্য দিয়ে প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে বিভিন্ন বিষয় সামনে চলে আসে। যার ফলে কোনো কিছুকে কীভাবে সবচেয়ে ভালোভাবে পরিচালনা করা যায়, সে সম্পর্কে বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে।
খেলাচ্ছলে উদ্ভাবন করা-
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কাল্পনিক বিভিন্ন বিষয়ও যুক্ত করা যায়। আর এতে করে ম্যানেজারদেরকে শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয় না। ফলে তারা আরো সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারেন।
বিস্ময়কর সাদৃশ্যগুলি কাজে লাগানো-
পরিচিত সমস্যাগুলি ভিন্নভাবে মোকাবেলার জন্য সাদৃশ্য খুঁজে বের করাটা অন্যতম কার্যকরী একটি পদ্ধতি। এজন্য বিশেষ কোনো শিল্প থেকে ধারণা নিয়ে সেটা অন্য একটি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, ক্যালিগ্রাফি এবং ‘বাউহাউস’ নামের স্থাপত্যরীতি নিয়ে স্টিভ জবসের ধারণা থেকেই অ্যাপলের মিনিমালিস্ট ডিজাইনের অনুপ্রেরণা এসেছে। তাই সাদৃশ্য অসম্পূর্ণ হলেও তাতে জটিল কোনো সমস্যাকে সমাধানযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার একটি খসড়া রূপরেখা সামনে আসতে পারে।
কোনো সমস্যাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে ম্যানেজাররা ওপরে আলোচনা করা এসব বিষয় চর্চা করতে পারেন। পাশাপাশি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনো সমস্যা পর্যালোচনা করতে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য ম্যানেজারদেরকে নিজের ঘাড়ে বাড়তি কিছু দায়িত্বও নিতে হবে। এসব দায়িত্বের মধ্যে প্রথম ধাপ হলো প্রতিষ্ঠানে এমন সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে সৃজনশীল কর্মীরা তাদের উদ্বেগ ও ধারণা মুক্তভাবে প্রকাশ করতে পারে।
এছাড়া উদ্ভাবন এবং চিন্তাভাবনার জন্য যাতে কর্মীদের হাতে যথেষ্ট সময় ও সুযোগ থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুন করে এসব উদ্যোগ নেয়া হলে তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বাড়বে না। তবে ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদী সমৃদ্ধির জন্যে এসব পরিবর্তন বেশ কাজে আসবে।