ওয়্যারলেস বা তারহীন যোগাযোগ বলতে বোঝায় কোনো তার, ক্যাবল বা অন্য কোনো ইলেকট্রিক কনডাকটর ছাড়াই নির্দিষ্ট দূরত্বে তথ্যের আদান-প্রদান। বর্তমানে যেকোনো ডিভাইসে তথ্য-উপাত্ত প্রেরণের জন্যে ওয়্যারলেস কম্যুনিকেশন হলো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম।
তারবিহীন কোনো যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি, ইনফ্রারেড বা স্যাটেলাইট ইত্যাদির মাধ্যমে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে কোনো ক্যাবল ছাড়াই তথ্য প্রেরণ করা যায়।
বিভিন্ন ধরনের তারবিহীন যোগাযোগ প্রযুক্তি ও পদ্ধতির ব্যাপারে এখানে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
রেডিও-
প্রথম দিকের তারবিহীন যোগাযোগ প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রেডিও যোগাযোগ হল অন্যতম। এখনো নানান ক্ষেত্রেই রেডিও ব্যবহৃত হয়। পোর্টেবল মাল্টি-চ্যানেল রেডিওর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা স্বল্প দূরত্বে যোগাযোগ করতে পারেন। আর সিটিজেন ব্যান্ড এবং ম্যারিটাইম রেডিও’র মাধ্যমে ট্রাকচালক ও নাবিকেরা দীর্ঘ দূরত্বে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন।
সাধারণত রেডিওর মাধ্যমে প্রেরিত তথ্য রেডিও তরঙ্গ হিসেবে বাতাসের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়। রেডিওতে একটি ট্রান্সমিটার থাকে, যা উপাত্তকে রেডিও সিগন্যাল হিসেবে রিসিভার অ্যান্টেনায় প্রেরণ করে।
ব্রডকাস্ট করার জন্যে সাধারণ রেডিও স্টেশনগুলি রেডিও নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকে। ব্রডকাস্ট সাধারণত দুইভাবে হয়। সেগুলি হলো, সিমুলকাস্ট এবং সিনডিকেশন।
সেলুলার-
সেলুলার নেটওয়ার্কে মূলত এনক্রিপ্টেড রেডিও সংযোগ ব্যবহার করা হয়। এতে একাধিক ব্যবহারকারী একটি সিঙ্গেল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে যোগাযোগ স্থাপন করার লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। যেহেতু হ্যান্ডসেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্রডকাস্ট করার ক্ষমতা থাকে না, তাই একাধিক সেলুলার টাওয়ারের মধ্যে স্থাপিত সংযোগের ওপর পদ্ধতিটি নির্ভর করে।
স্যাটেলাইট-
স্যাটেলাইট যোগাযোগ হলো এক ধরনের তারবিহীন প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট ডিভাইস পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইটের সাথে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।
এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সংযুক্ত থাকতে পারেন। পোর্টেবল স্যাটেলাইট ফোন বা মডেমের মতো ডিভাইসে সেলুলার ডিভাইসের চাইতেও শক্তিশালী ব্রডকাস্টিং সিস্টেম এবং হার্ডওয়্যার থাকে। এর কারণ হলো পোর্টেবল স্যাটেলাইট ফোন বা মডেমের রেঞ্জ থাকে অনেক বেশি।
স্যাটেলাইট যোগাযোগ তৈরি হয় স্পেস সেগমেন্ট এবং গ্রাউন্ড সেগমেন্ট-এর সমন্বয়ে। একটি ট্রান্সমিটার ও রিসিভারের সমন্বয়ে গ্রাউন্ড সিস্টেম তৈরি হয়। আর স্যাটেলাইটকেই বলা হয় স্পেস সেগমেন্ট। যখন একটি ডিভাইসের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে কোনো বার্তা প্রেরণ করা হয়, তখন স্যাটেলাইট সেই বার্তাকে বিবর্ধিত করে রিসিভার অ্যান্টেনায় ফেরত পাঠায়। এই রিসিভার অ্যান্টেনা পৃথিবীর পৃষ্ঠে থাকে। আর এভাবেই স্যাটেলাইট ব্যবস্থায় যোগাযোগ করা যায়।
ওয়াই-ফাই-
ওয়াই-ফাই হলো কম খরচের তারবিহীন যোগাযোগ প্রযুক্তি। ওয়াই-ফাই সেটআপ গঠিত হয় তারবিহীন একটি রাউটার ও পোর্টেবল ডিভাইসকে ইন্টারনেট কানেকশনের সাথে যুক্ত করার মাধ্যমে। রাউটার মূলত কম্যুনিকেশন হাব হিসেবে কাজ করে। আর ওয়াই-ফাই সংযোগের মাধ্যমে স্থাপিত এই নেটওয়ার্ক বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে সংযোগকে সহজ করে তোলে। প্রক্রিয়াটি রাউটার কনফিগারেশনের ওপর নির্ভর করে। কম ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিশনের কারণে এই নেটওয়ার্কের পরিসর বেশ সীমিত। ফলে ব্যবহারকারীরা কেবল স্বল্প ও নির্দিষ্ট পরিধির ভেতরেই সংযোগ পেতে পারেন।
ওয়াই-ফাই হচ্ছে তুলনামূলক কম ক্ষমতাসম্পন্ন তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের মতো বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ব্যবহার করা যায়। তবে ব্যবহারকারীরা কেবল রাউটার বা সিগন্যাল রিপিটারের কাছাকাছি স্বল্প ও নির্দিষ্ট দূরত্বের ভেতরেই সংযুক্ত হতে পারেন। হোম নেটওয়ার্কিং অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে ওয়াই-ফাই এর ব্যবহার বেশি। সাধারণত অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ ঠেকানো ও নিরাপত্তাজনিত কারণে পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে ওয়াই-ফাই-কে নিরাপদ রাখতে হয়।
ব্লুটুথ টেকনোলজি-
ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে যেকোনো সিস্টেমের সাথে তার ছাড়াই সংযুক্ত করা যায়। এই সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য হলো তথ্য ও উপাত্ত আদান-প্রদান করা। মূলত এটিই ব্লুটুথের মূল কাজ। এর সাহায্যে সেলফোনকে হ্যান্ড-ফ্রি ইয়ারপিসের সাথে সংযুক্ত করা যায়। এছাড়াও এর সাহায্যে ল্যাপটপের সাথে ওয়্যারলেস কিবোর্ড, মাউস এবং মাইক সংযুক্ত করা সম্ভব। এটি এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করে। ব্লুটুথ প্রযুক্তি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ওয়্যারলেস কম্যুনিকেশন মার্কেটে।
জিগবি-
জিগবি হলো এক ধরনের তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই প্রযুক্তিটি মূলত কম ক্ষমতা সম্পন্ন ও কম খরচের ওয়্যারলেস সেন্সর এবং কনট্রোল নেটওয়ার্কের প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। জিগবি যেকোনো জায়গায় ব্যবহার করা সম্ভব। কারণ এটি কাজ করতে খুব অল্প পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়। সেন্সর থেকে ডেটা সরবরাহের মত একটি সহজ পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য যোগাযোগের কথা মাথায় রেখে জিগবি তৈরি করা হয়েছে।
ওয়াইম্যাক্স-
এমন অনেক ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড সিস্টেম রয়েছে, যার মাধ্যমে ক্যাবল ছাড়াই দ্রুতগতিতে ওয়েব সার্ফিং করা যায়। ওয়াইম্যাক্স এমনই একটি ওয়্যারলেস ব্রডব্যান্ড পদ্ধতির উদাহরণ। ওয়াইম্যাক্স ৩০ মেগাবিট পার সেকেন্ড রেটে ডেটা সরবরাহ করতে পারে। তবে ব্রডব্যান্ড সংযোগের চাইতে এই সার্ভিসের গতি কম হয়ে থাকে। তাছাড়া ওয়াইম্যাক্স ব্যবহার করে তথ্য সরবরাহের খরচও সুনির্দিষ্ট নয়। বর্তমানে ফোনে যে ৪জি ব্যবহৃত হয়, তা ওয়াইম্যাক্সের অন্যতম একটি সংস্করণ।