সহজ কথায় এডুটেইনমেন্ট হলো এডুকেশন + এন্টারটেইনমেন্ট। যদিও এই সহজ সমীকরণ দিয়ে ‘এডুটেইনমেন্ট কী?’ সেই প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর পাওয়া যায় না। খুব সহজে বললে, এডুটেইনমেন্ট বিনোদনের এমন একটা ধরন, যাতে আনন্দের মাধ্যমেই শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়।
ওয়াল্ট ডিজনি তার “ট্রু-লাইফ অ্যাডভেঞ্চার্স” সিরিজকে বর্ণনার জন্যে প্রথমবারের মতো ‘এডুটেইনমেন্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
প্রযুক্তিগত উন্নতি, উপকরণের সহজলভ্যতা এবং প্রোগ্রামিংয়ের সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ফলে এডুটেইনমেন্ট এখন অনেক সহজেই ব্যবহার করা যায়। এতে করে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকতা এবং শেখার ব্যবস্থাকে উন্নত করে তোলার যে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ, সেটিও দিন দিন বাড়ছে। এডুটেইনমেন্টের বেশ কিছু উদাহরণ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক এবার।
বুলেভার্ড-
একই সাথে আর্ট ক্লাস এবং বিশ্বের সেরা কয়েকটি আর্ট মিউজিয়ামে ভার্চুয়াল ভিজিটের অভিজ্ঞতা নেয়া যাবে বুলেভার্ড নামের এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে। প্লাটফর্মটি নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করে থাকে: “যেকোনো ভার্চুয়াল, অগমেন্টেড এবং মিক্সড রিয়্যালিটির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর নিয়ন্ত্রণাধীন অভিজ্ঞতা প্রদান এবং মগ্ন হওয়ার মতো সমৃদ্ধ আর্ট এডুকেশন কনটেন্ট তৈরি।”
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টেক এডভোকেট গ্রুপ থেকে প্রকাশিত “বেস্ট টিচিং আ্যন্ড লার্নিং আ্যপস” এর তালিকায় বুলেভার্ড-এর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই প্লাটফর্মটি শিক্ষার্থীদের ৬টি আর্ট মিউজিয়ামে ভ্রমণ করে বিখ্যাত শিল্পকর্মের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে আর্ট সম্পর্কে শেখার সুযোগ করে দেয়।
এবিসি মাউস-
২ থেকে ৬ বছর বয়সীদের জন্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত অনলাইন শিক্ষা সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইট হলো ‘এবিসি মাউস’। ABCmouse.com ১০ টি ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত ৮৫০টি অধ্যায় এবং ৯০০০ অনুশীলনীর সমন্বয়ে শিক্ষকদের জন্যে মূল বিষয়গুলি পড়ানোর নতুন এক পথ খুলে দিয়েছে।
এমনকি এবিসি মাউস ব্যবহারকারী শিক্ষকদের কয়েকজন বিভিন্ন পরীক্ষাতে সর্বোচ্চ স্কোর করেছেন। সাইটটির অ্যাওয়ার্ডের তালিকায় রয়েছে লার্নিং ম্যাগাজিনের টিচার্স চয়েজ অ্যাওয়ার্ড।
প্রডিজি-
বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্যে বিনামূল্যে এই সাইটের পাঠ্যক্রম-ঘনিষ্ঠ গণিতের গেমস এবং অনুশীলনীগুলি ২০ মিলিয়নেরও বেশি শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবক ব্যবহার করে থাকেন। সাইটটিতে ১২০০-এরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক দক্ষতার পাঠ রয়েছে।
এটি রিয়েল-টাইম প্রতিবেদনের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের শেখার ওপরও নজর রাখে। ফলে, শিক্ষার্থীরা কী কী দক্ষতা অর্জন করছে এবং কোথায় তাদের আরও সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে, শিক্ষকরা তা বুঝতে পারেন।
ক্র্যাশ কোর্স-
৮.৫ মিলিয়নের বেশি সাবস্ক্রাইবার এবং প্রায় ১ বিলিয়ন ভিউ নিয়ে ইউটিউবে সর্বাধিক দেখা শিক্ষা সংক্রান্ত চ্যানেলগুলির একটি হলো ক্র্যাশ কোর্স।
ক্র্যাশ কোর্স অনেক বিষয়েই সংক্ষিপ্ত এবং আকর্ষণীয় পাঠদান করে। এর মধ্যে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, সরকারব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাজনীতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা, বিশ্ব ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, সাহিত্য, বাস্তুশাস্ত্র, রসায়ন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, পুরাণ, কম্পিউটার বিজ্ঞানের মতো আরো অনেক কিছু।
লেগো-
বিখ্যাত বিল্ডিং ব্লক খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লেগোর উৎপত্তি ১৯৪৯-এ হলেও বর্তমানে এটি শিক্ষকদের জন্যে ‘মাইন্ডস্টর্ম’-এর মতো প্যাকেজ সহ মোবাইল রোবট কীভাবে তৈরি করতে হয়, তা শিখতে শিশুদের সহায়তা করছে। ফলে লেগো এখন ক্লাসরুমেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘লেগো মাইন্ডস্টর্ম’ কোডিং, রোবোটিকস এবং বাস্তব জীবনের নানান সমস্যা সমাধানের জন্যে বাচ্চাদের দক্ষ করে তোলার উদ্দেশ্যেই ডিজাইন করা হয়েছে।
আর্ট সংক্রান্ত নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন হোক কিংবা লেগোর মত ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় কিছু হোক, শিশু-কিশোরদের কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন সব সৃজনশীল পণ্যের বিস্তারের সাথে সাথে এডুটেইনমেন্টের বাজারও দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে।
শিক্ষাগত দিক বিবেচনায় এডুটেইনমেন্টের কিছু সুবিধা এবং সমালোচনাগুলি দেখা যাক এবার।
শ্রেণিকক্ষে এডুটেইনমেন্ট ব্যবহারের সুবিধা ও সমস্যা-
শিক্ষা কার্যক্রমে এডুটেইনমেন্ট সরঞ্জাম ও সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হলো চটকদার বিভিন্ন বিনোদন সামগ্রীতে শিক্ষার্থীদের অতি অভ্যস্ত হয়ে পড়া। ফলে যেকোনো কিছু শেখার জন্যেই এই এডুটেইনমেন্ট মডেলগুলির ওপর তাদের সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।
এডুটেইনমেন্ট সংক্রান্ত অন্যান্য সমস্যাগুলি হলো-
- ডিভাইসের ব্যবহার বরং কিছু শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে।
- প্রযুক্তিগত ভাবে সব শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের ভেতরে-বাইরে সমান সুবিধা নেই।
- অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভরতা শিক্ষার্থীদের মধ্যকার পারস্পরিক মানবিক যোগাযোগের পরিমাণ কমিয়ে তাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- এমনকি এই ধ্যানধারণাও ক্ষতির কারণ যে, পড়াশোনা আসলে খুব ‘মজার’ কিছু না।
তবে শিক্ষাক্ষেত্রে এই নতুন প্রযুক্তি-পদ্ধতির সমালোচনার তুলনায় শ্রেণিকক্ষে এর সাফল্যের গল্প এবং চমৎকার সব সুবিধার তালিকার পাল্লাই বেশি ভারি। শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধার ব্যবহার বাড়লে প্রযুক্তিনির্ভর দুনিয়াতে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ যন্ত্রগুলি আয়ত্ত করতে এবং সুদক্ষ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
ডিজিটাল যুগে সফলতার জন্যে আবশ্যক “মিডিয়া লিটারেসি” সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি এডুটেইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের শেখার কাজটিকেও আরো নানান উপায়ে সহজ করে দিতে পারে। যেমন-
- প্রযুক্তি যেকোনো স্থানে পৌঁছাতে পারে বলে নির্দিষ্ট ক্লাসরুমের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা যেকোনো জায়গায় বসে শিখতে পারে।
- শেখার সঙ্গে আনন্দ যোগ হলে বাচ্চারা সহজেই সত্যিকার অর্থে যেকোনো বিষয় মন দিয়ে শেখে।
- সুচিন্তিত ভাবে বেছে নেওয়া অনলাইন পোর্টালগুলি শিক্ষার্থীদেরকে অবাধ তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ দেয়।
- STEM সহ প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের অন্যতম সেরা উপায় হলো এডুটেইনমেন্ট।
- শিক্ষার্থীরা সহজেই কোডিং-এর মতো আধুনিক প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারবে এর মাধ্যমে।
- হাতে-কলমে শেখা শিক্ষার্থীদেরকে আনন্দ দেয় এবং তাদের কল্পনাকে অনুপ্রাণিত করে।