‘চালকবিহীন গাড়ি’ বললে কোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনি বা সিনেমার কথা মনে হতে পারে। কিন্তু সেই দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। চালকবিহীন গাড়ি ব্যাপারটা ধীরে ধীরে কল্পনা থেকে বাস্তব হয়ে উঠছে। সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে বড় বড় গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলি যেভাবে গবেষণার কাজে বিনিয়োগ করছে, তাতে বলাই যায় মোটর ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ এমন স্বয়ংক্রিয় গাড়িরই হাতে।
কিন্তু এই গাড়িগুলি আসলে কীভাবে চলে?
চালকবিহীন গাড়িগুলি, তাদের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সবগুলির মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যা মোটাদাগে বলা চলে ওয়েমো’র (Waymo) বৈশিষ্ট্যের মতোই।
প্রথমত, এই গাড়িগুলিতে গাড়ির ছাদে লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেইঞ্জিং সেন্সর, সংক্ষেপে লিডার (LiDAR) বসানো থাকে। লেজার লাইটের মাধ্যমে এই সেন্সর গাড়ির চারপাশের অবস্থান, রাস্তার কিনারা ও রোড ডিভাইডার সম্পর্কে ধারণা নিতে থাকে।
দ্বিতীয়ত, এই গাড়িগুলিতে সংযুক্ত থাকে রাডার সেন্সর। এর মাধ্যমে চালকবিহীন গাড়ি তার আশেপাশে থাকা গাড়িকে পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সংঘর্ষ এড়াতে আশেপাশের গাড়িগুলির অবস্থানের সাথে সাথে তাদের গতিও পর্যবেক্ষণ করে থাকে এই সেন্সর।
তৃতীয়ত, ভিডিও ক্যামেরা প্রযুক্তির মাধ্যমে এই গাড়িগুলি স্পিডব্রেকার বা সড়কের অন্যান্য বাধাসহ পথচারীদের নজরে রাখে। সড়ক নির্দেশনা ও ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ার কাজটিও করতে পারে এই প্রযুক্তি।
চতুর্থত, এই গাড়িগুলির চাকার মধ্যে আল্ট্রাসনিক সেন্সর যুক্ত থাকে। পার্ক করা এবং গাড়ি ঘোরানোর সময় এই সেন্সরগুলির মাধ্যমে অন্য কোনো গাড়ি বা রাস্তার সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়।
পঞ্চমত, এই গাড়িগুলিতে থাকে একটি সেন্ট্রাল কম্পিউটার সিস্টেম, যা ওপরে পাওয়া তথ্যগুলি প্রসেস করে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে স্টিয়ারিং, এক্সেলারেশন ও ব্রেকিং হয় একদম নির্ভুল।
চালকবিহীন গাড়ির সুবিধা-
মোটর ইন্ডাস্ট্রি যে চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলির দিকে দ্রুত ঝুঁকছে তার মূল কারণ, ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে এই প্রযুক্তি হবে একটা নতুন বিপ্লব। এর সুবিধা হবে অপরিসীম।
প্রথমত, মানুষের স্বাভাবিক ভুল বা হিউম্যান এররের কারণে যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তা কমিয়ে আনাই হবে এর সবচেয়ে বড় অবদান।
চালকবিহীন গাড়ির সর্বশেষ কিছু প্রটোটাইপ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তারা ভাঙা রাস্তা, ভাঙা গাড়ির টুকরা ইত্যাদি শনাক্ত করতে পারছে এবং সাইক্লিস্টদের সাথে ব্যস্ত সড়কেও সমান্তরালে অনায়াসে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারছে।
এমনকি, এই গাড়িগুলি থাকবে ইলেকট্রিক চালিত অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব। এছাড়া, ক্লাউড ভিত্তিক ইন্টারনেটে যুক্ত থাকার কারণে গাড়িগুলি ট্রাফিক ব্যস্ততাও টের পাবে আগে থেকেই। সেই অনুযায়ী পথ এবং গতি পাল্টিয়ে দ্রুত পৌঁছাতে পারবে গন্তব্যে। ফলে ন্যূনতম কার্বন ব্যবহারের কারণে এই গাড়িগুলি হবে গ্রিন ড্রাইভিংয়ের উদাহরণ।
চালকবিহীন গাড়ির ঝামেলা-
চালকবিহীন গাড়ির সবচেয়ে বড় ঝামেলা, এটি এখনও পারফেক্ট হয়ে ওঠেনি। তেমন নিখুঁত আর নির্ভুল হয়ে উঠতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। কেন?
প্রথমত, প্রটোটাইপগুলি এখনও স্বনির্ভর হয়ে ওঠেনি। কোনো সমস্যা হলে সামাল দেয়ার জন্য সেগুলিতে এখনও দক্ষ চালকের প্রয়োজন হয়। গাড়ি চালাতে পারে না এমন কারো জন্য কাজে লাগাতে এই গাড়িগুলিকে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এই চালকবিহীন গাড়ির নিরাপত্তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি গুগলের একটি চালকবিহীন গাড়ির সাথে একটি বাসের সংঘর্ষের ঘটনা এই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ধারণা করা গেছে, গাড়িটি যদি একজন মানুষ চালাতো, তাহলে এই সংঘর্ষ এড়ানো হয়ত সম্ভব হতো। সংশয়বাদীরা আরও সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, যদি কেউ এই গাড়িগুলিকে হ্যাক করে, তাহলে কী হবে? কিংবা দ্রুত গতিতে চলমান থাকা অবস্থায় যদি বিদ্যুৎ ফুরিয়ে যায় বা নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন কী ঘটবে?
প্রচণ্ড শীত বা গরম বা বৃষ্টির মতো চরম পরিস্থিতি এই গাড়িগুলি কেমন সামাল দেয়, তাও একটা দেখার বিষয়। এই ব্যাপারগুলিতে এখনো সন্তোষজনক নিশ্চয়তা পাওয়া যায় নি।
চালকবিহীন গাড়ির ব্যাপারে অনেকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তবে এই ব্যাপারে সরকারি বিধিনিষেধ যত কমে আসবে, এবং বড় বড় গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলি যত বেশি এই প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে আসবে, তত দ্রুতই এই কল্পনা বাস্তব হয়ে উঠবে।